ফাইজ় তাইয়েব আহমেদ
আপনারা এমন একটা রাষ্ট্র বানিয়েছেন যেখানে পার্টিগার্লকেও স্বগোত্রীয়দের মাধ্যমে হেনস্তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাওয়া লাগে।। আমি জানি, এগুলা নিয়েও আপনাদের ভাবার সময় নেই, আপনাদের দরকার পার্টি করার জৌলুশময় জায়গা, গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড নিয়ে আড্ডার ভাল স্পট, অভিজাত বিপনী সিনেমা, পাওয়ার বাইকের মূল্যছাড় বড় জোর স্মার্ট ফোনের কম দাম, আর একটু সাশ্রয়ী ইন্টারনেট জিবি। মাফিয়াগিরি, বেপারোয়া দুর্নীতিতে উপার্যিত টাকার শ্রাদ্ধ করার একটা উপযোগই রাষ্ট্রের কাছে আপনাদের প্রধানতন চাওয়া। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রবর্তন, স্বচ্ছ নির্বাচন, জবাবদিহি মূলক ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠানিক শাসন, একটা স্বচ্চ বিচারকি কাঠামো- এগুলা কোন ছাই! আপনাদের চাই, উদযাপনের আয়োজন। উদযাপনে কখনও খটকাটা বাঁধলে, সেটাই হয়ে উঠে আপনাদের মূল সমস্যা, এই রাষ্ট্রের অন্য কোন সমস্যাকে আপনারা সমস্যাই মনে করেন না।
আপনারা এমন একটা রাষ্ট্র বানিয়েছেন যেখানে গুম হওয়ার চার দিন পরেও একজন ইসলামী বক্তার পরিবার সাধারণ একটা জিডি করতে পারছে না। ইসলামী বক্তার ‘গুম না হওয়ার’ অধিকারের পক্ষে দুটা কথা বলাও আপনাদের সমাজে ক্ষেত বিবেচ্য।
আপনি অভিজাত, বিম্পি জামাতের বাইরে বিকল্প নাই বলে ক্ষমতালীগ সমর্থন করে থাকেন কিংবা আপনি সরাসরি চেতনার দলে, পান থেকে চুন খসলেই আপানকে প্রধানমন্ত্রীর কাছেই বিচার দিতে হবে, কেননা বিচার দেয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটা ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে কাজ করে না এই রাষ্ট্রে। এটা চেতনা ওয়ালা হিসেবে আপনার জন্য বিশাল সুযোগ, এমনকি মর্যাদারও বটে। নিজেকে ‘এলিট’ হিসেবে এস্টাব্লিশ করার, মিডিয়া এটেনশান ক্লেইমের এই সুযোগ আপনার মিস করা ঠিক না। নানান ঢং এর অভিযোগ, অনুযোগ, অনুনয় এবং বিনয়ী বিচারের বাহারই আপনি করবেন, না কোন থানা-পুলিশে নয়, খোদ বঙ্গ ভবনে!
অনেক হৈচৈ হবার প্রেক্ষিতে আপনার ‘থ্যাংক ইউ পিএম’ কে চোখ তুলে বলতে হয়, এর বিচার হবে, কেউ ছাড় পাবে না। এই স্থির করে দেয়া ক্ষেত্র বিশেষ ছাড়া এখানে ‘প্রভাব না খাটাতে পারা’দের জন্য ন্যায় বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রায় শূণ্য। আপনি, শহুরে এলিট ও শহুরে মধ্যবিত্ত যখন নিজেই এই শূণ্যের কাছাকাছি পড়ে যান, তখন আপনাদের কি যে হতাশ লাগে, সেটা বুঝতে পারি!
আপনারা এমন রাষ্ট্র বানিয়েছেন যেখানে, শুধু ব্যাপক হৈচৈ হবার প্রেক্ষিতেই কেবলমাত্র সুবিচারের আপাত একটা প্রাসঙ্গিকতা তৈরি হওয়া শুরু হয়। এবং সেটা হলেই দিনশেষে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা লাগে। প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত হস্তক্ষেপ ছাড়া এখানে ন্যায়বিচার অসম্ভব। এটাকে ফ্রেজাইল রাষ্ট্রের অনুষঙ্গ বললে, পাছে আপনারা তেড়ে আসেন! এই ভয়ে থাকি।
সমস্যা হচ্ছে, খোদ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেও অনেক ক্ষেত্রে কোন কাজ হয়নি, কাজ হয় না। কারণ প্রশাসন ও আদালতে, ব্যবসা ও কর্পোরেটে যারা বসে আছে তারা ‘আওয়ামী লীগ’ করার কিংবা আওয়ামী লীগকে দেয়ার দীর্ঘ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, রাতের ভোটের পরীক্ষিত কারিগর। তারা একেকজন মন্ত্রীর চেয়েও বড় আওয়ামীলীগার। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীকে আপোষ করতে লাগে সময় সময়। ক্ষমতা বলয়ের কেউ অপরাধ করলে প্রধানমন্ত্রীও মাঝে মাঝে বিচার করতে নিদারুণ ভাবে অক্ষম! উনি বড় জোর আপোষ করতে বলেন। ষড়যন্ত্রের রঙ্গভবনে বিচার নেই বরং আপোষ হয় সেখানে। যে প্রধানমন্ত্রীকে কর্পোরেট, বড় ব্যবসায়ী, প্রশাসন ও আদালত করুণা করে ক্ষমতায় রেখেছে, তার হস্তক্ষেপ সময়ে সময়ে ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্টের’ জায়গা গুলোতে বাস্তবায়িত হবে না, এটাও তো স্বাভাবিক। এটা যখন আপনাদের বিরুদ্ধে যায়, তখন আপনাদের খ্রাপ লাগে। তবে আখেরে, এতেও আপনার সমস্যা নাই, কারণ আপনি গোল্ডফিশ। ইস্যুর চাপে ইস্যু ভুলে যান। ইস্যু ভিত্তিক স্যাটায়ার, ইয়ার্কি কিংবা সার্কাজম পোষ্টেই বরং আপ্নার মজা বাড়ে।
আপনারা এমন একটা দেশ বানাইসেন, যেখানে আলোচিত মামলার জামিন, থানার ওসির বদলি থেকে শুরু করে সচিবের ফাইলের সুরক্ষা সব ক্ষেত্রেই পরধান মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করা লাগে। এক ব্যক্তির ইচ্ছাই একটা পুরো সংসদ, পূরো মন্ত্রণালয়, পুরো প্রশাসনের সিদ্ধান্ত ও কাজের মূল প্রভাবক। এক ব্যক্তির সিদ্ধান্তই রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের ছায়া। সব সিদ্ধান্তের জন্য সবাইকে তাঁর দিকে হা করে চেয়ে থাকতে হয়। হেড অফ স্টেইটের (ডি ফ্যাক্টো যদিও) এমন মাইক্রো ও ন্যানো ম্যানেজমেন্টের নজির বিশ্বের কোথাও এই উত্তরাধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সময়ে আছে কিনা আমার জানা নেই, কারো কোন চূড়ান্ত ডেলিগেশান কিংবা লেজিটিমেইট কোন অথোরিটি নেই! বিচিত্র সেলুকাস!
বলতে পারেন, আমাদের ইন্সটিটিউশান, সংসদ, আইন আদালত ও সংবিধানের ধারা, এগ্লা? দোউজ রিয়েলি হ্যাভ হার্ডলি এনি ইনপ্যাক্ট। মূলত ডি ফ্যাক্টো কর্তার ইচ্ছাই কর্ম।
আইন ও বিচারের স্বভাবিকতাটাকে যেহেতু খেয়ে দেয়া হয়েছে, এখন জল পড়লেও পাতা নড়ে না। নড়বে না। ক্ষমতাবান অপরাধ করলে পুলিশে মামলা জিডি নিতে পারে না। ঠিক যেভাবে খেলার মাঠের আম্পায়ার আউট হলেও আউট দিতে পারে না। ১২ বছর ধরে ড্রেনের টাকা লুট করা ওয়াসার এমডি একই কারনে পরিবর্তন হয় না, বৃষ্টিতে আপনার শহর রাস্তা বাসার নীচতলা তলিয়ে গেলেও কোথাও কিছু বলার স্পেইস আপনার নেই। সবকিছুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়া লাগে।
আপনারা এমন একটা রাষ্ট্র বানিয়েছেন যেখানে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কাজকে, তাঁর অফিসকে কিংবা তাঁর ডেলিগেশানকে থানার কনস্টেবল, মাঠের আম্পায়ার কিংবা ড্রেনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। কি সাংঘাতিক!
ফাইজ় তাইয়েব আহমেদ, লেখক ও গবেষক
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, স্টেটওয়াচ কর্তৃপক্ষের নয়।
আপনার মতামত জানানঃ