সিদ্ধার্থ আদিত্য
বিগত কয়েক বছরে বই প্রকাশ এবং তার পাঠ অভিজ্ঞতায় কিছু অদ্ভুত বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে; তার মধ্যে আজ একটি মজাদার গল্প আপনাদের বলব। অতি সম্প্রতি একটি বই নিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে আমার, তারই ধারাবাহিকতায় বিষয়টির গভীরতা খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে এটি একটি প্রাচীণ প্রবাদ “উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে” হয়ে উঠছে সম্ভবত। ২০১১ সালে ইজরাইলের ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারি “স্যাপিয়ান্স” নামে তাঁর মাতৃভাষা হিব্রুতে একটি বই প্রকাশ করেন; বইটির প্রথম প্রকাশক ছিলেন ইজরাইলের Dvir Publishing House; ২০১৪ সালে বইটির ইংরেজি সংস্করণ বের হয় এবং পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়; এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে এই বইটির ৩টি অনুবাদ এবং একটি রূপান্তর প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রকাশনীর বইতে দেখতে পাওয়া যায়, “(লেখকের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী)” তাঁরা এটির অধিকার রাখেন এবং বাংলাদেশে অন্য কেউ এটি আর প্রকাশ করার অধিকার রাখেন না। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে একজন ইজরাইলী ঈহুদী লেখকের সাথে বাংলাদেশের কোনো প্রকাশনীর “চুক্তি” কীভাবে সম্পাদিত হয়, এবং এর খোঁজ নিতে গিয়েই “উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে” প্রসঙ্গটি উঠে আসে।
ইউভাল নোয়া হারারির নিজস্ব ওয়েবসাইট যাচাই করলে দেখা যায়, “স্যাপিয়ান্স” বইটির অনুবাদস্বত্ব ভাষা এবং দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে; ইংরেজী ভাষায় ৭টি দেশের ৭টি প্রকাশকের অনুবাদ অধিকার আছে (ছবি নং ১); এমনকি ইজরাইল ছাড়া সমগ্র পৃথিবীতে বই রপ্তানি করার অধিকার নিয়ে আরবী অনুবাদস্বত্ব আছে ভারতীয় Manjul Publishing House-এর (ছবি নং ২)। মানজুল ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইট অনুসারে তাঁদের কাছে ভারতে বিপননের জন্য বাংলা ছাড়া অন্য অন্য ভাষায় মোট ১০টি অনুবাদস্বত্ব আছে। এতক্ষণ পর্যন্ত সব ঠিক আছে, কিন্তু বিপত্তি শুরু হয়েছে বাংলা অনুবাদস্বত্বের বেলায়।
ব্যক্তিগত খোঁজে জানতে পেরেছি, স্যাপিয়ান্স বইটির অনুবাদস্বত্ব দেবার বিষয়ে আইনী অধিকার রাখে The Deborha Harries Agency (ছবি নং ৩), এটি একটি ইজরাইলী প্রতিষ্ঠান এবং সেখানেই তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক ঠিকানা; তাঁদের ওয়েবসাইটে স্যাপিয়ান্স বইটির অনুবাদস্বত্ব বিক্রির বিষয়ে যে তালিকা দেখা যায় তাতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান Manjul Publishing House এর স্বগর্ব উপস্থিতি আছে (ছবি নং ৪)। বিপত্তিটি শুরু হয় এখানেই, The Deborha Harries Agency ওয়েবসাইটের বিগত কয়েকদিন পূর্ব পর্যন্ত থাকা তথ্য মতে তাঁরা তাদের স্যাপিয়ান্স বইটির বাংলা অনুবাদস্বত্ব বিক্রি করছে ভারতীয় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কাছে (ছবি নং ৫); যে প্রতিষ্ঠানটির সাথে বাংলাদেশী ২০১৯ সালে “(লেখকের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী)” লেখা প্রকাশনীটির নামের মিল আছে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে The Deborha Harries Agency-র ওয়েবসাইটে এটিকে একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখানো হয়েছে কেনো?
সম্প্রতি ফেসবুক নির্ভর একটি বই সংগ্রহকারী ক্লাবকে বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানটি আইনী এবং কপিরাইট নোটিশ পাঠিয়েছে এবং একটি বৃহৎ অংকের ক্ষতিপূরণ দাবী করেছে বলে জেনেছি; ক্লাবটির ভাষ্যমতে তাঁরা এটি The Deborha Harries Agency-র ওয়েবসাইটে থাকা ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া অনুবাদস্বত্বের বিষয়টি দেখেই বাংলাদেশে সংগ্রহ করা সম্ভব ভেবেই বইটির একটি নতুন অনুবাদ ছাপতে উদ্দ্যেগী হয়েছিলো এবং সেটা তাঁরা কোনো প্রকার আর্থিক লাভের ইচ্ছা ত্যাগ করেই করেছিলো। মজার কথা হচ্ছে অতি সম্প্রতি The Deborha Harries Agency-র ওয়েবসাইটে থাকা ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে বাংলা অনুবাদস্বত্ব বিক্রির বিষয়টিতে ভারতীয় (India) শব্দটি তুলে দিলেও, কোন দেশের বাংলা, তা নির্দিষ্ট করেনি (ছবি নং ০৬)।
এবার “উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে” প্রসঙ্গ; যদি The Deborha Harries Agency-র ভুলের কারণে বাংলাদেশী ক্লাবটি নতুন একটি ভুল করেও থাকে, তবে তার দায় আসলে কতটা ক্লাবটির উপরে বর্তায় এবং যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশী প্রকাশনাটি “(লেখকের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী)” এটির কপিরাইট পেয়েই থাকে তবে একটি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইজরাইলী প্রতিষ্ঠানের সাথে কীভাবে কোন আইনে “চুক্তি” সম্ভব? প্রশ্ন আসতে পারে, লেখক তাঁর নিজ ক্ষমতায় নিম্ন আয়ের একটি দেশকে বিনা অর্থে অথবা কম অর্থে বইটি প্রকাশের লিখিত অনুমতি দিতেই পারেন; তবে সেটিকে কেনো The Deborha Harries Agency অনুবাদস্বত্ব বিক্রির তালিকায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখিয়েছিলো?
ভুলে যাবেন না; বাংলাদেশ এখনও দ্বিপাক্ষিকভাবে ইজরাইলের সাথে কোনো চুক্তি থাকার বিষয়টি সমর্থন করে না, কারণ বাংলাদেশ এখনও ইজরাইলকে দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি। সচেতন নাগরিক এবং মুক্তমনা মানুষদের কাছে বিষয়টি নজরে আনার জন্যই এই লেখা; আপনারা ভেবে দেখবেন; শক্তি প্রদর্শনের খেলায় একটি বই নিয়ে কিছু বই পাগলদের ভালোবাসার উদ্দ্যেগ যেনো “উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে” দোষে বিলুপ্ত না হয়ে যায়।
আপনার মতামত জানানঃ