সিদ্ধার্থ আদিত্য
বাংলাদেশ এখন এক নীরব ইসলামী বিপ্লবের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠাকালীন চেতনার জায়গা থেকে সরে এসে এখন একটা উগ্র ইসলামিক ভূখণ্ডে রূপান্তরিত হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণ, কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, কি শহরের কি গ্রামের, কি ধনি কি গরীব, সকলে মিলেই ইসলামি সংস্কৃতি এবং ইসলামি শরীয়া শাসন এডাপ্ট করার জন্য ব্যাপকভাবে মানসিক ও সামাজিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই প্রস্তুতিটা যেমন জনগণের পক্ষ থেকে হচ্ছে তেমনি শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকেও হচ্ছে। কি বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? তাহলে একে একে কিছু পয়েন্ট আপনাদের সামনে তুলে ধরি, বাকিটা আপনাদের বিবেচনার উপর ছেড়ে দিলাম।
সাধারণ শিক্ষার অবমূল্যায়ন
এই দেশের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থাকে খুব পরিকল্পিত উপায়ে অধঃপতিত করা হয়েছে। বৃটিশ শাসনে মানুষ জেনারেল শিক্ষার সুযোগ পেত না কিন্তু যারা শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পেত তারা সেই সময়ের সবচেয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষাটাই পেত, পাকিস্তান আমলেও এই ধারাটা অব্যাহত ছিল। আমাদের দেশেও ৯০ দশকের শেষ পর্যন্ত মোটামুটি একটা প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার গণ হারে পাশের ব্যবস্থা করে এবং শিক্ষা কার্যক্রমে প্রচণ্ড রকম ঢিলেঢালা এপ্রোচ নিয়ে এসে এই জেনারেল শিক্ষা ব্যবস্থাকে একেবারে কবরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য মৌলবাদী গোষ্ঠীর চাপে অনেক প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিকদের রচনাকে অপসারণ করার ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি সংস্কৃতি ও মানবিক সংবেদনশীলতার চর্চা এই শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যসূচি থেকে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে এই শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যারা বের হচ্ছে তারা অনেক ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হচ্ছে কিন্তু মাথায় জ্ঞান বুদ্ধি খুব একটা থাকছে না। ইদানীং দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা কিংবা সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা প্রথম দ্বিতীয় হচ্ছেন এবং তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ হৈ চৈ হচ্ছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের এই ভালো ফলাফলকে বিশেষভাবে সেলিব্রেট করা হচ্ছে এবং মাদ্রাসার শিক্ষাকে গ্লোরিফাই করা হচ্ছে। দেশের এক প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান তো বলেই ফেললেন “মাদ্রাসার শিক্ষকরা ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষকদের চেয়ে বেশী জ্ঞানী, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন অধ্যাপকও নেই যারা মাদ্রাসার শিক্ষকদের সাথে যুক্তি–তর্কে পারবেন!” বাড়ছে মাদ্রাসার সংখ্যা এবং মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি বেসরকারি বরাদ্দের পরিমাণ।
শিল্প সংস্কৃতি ধ্বংস
দেশের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে একেবারে পঙ্গু বানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ দেশে আর কোন ভালো সিনেমা তৈরি হয় না, ভালো নাটক তৈরি হয় না, ভালো শিল্পী তৈরি হয় না। যারা এক সময়ের সেলিব্রেটি অভিনেতা/ অভিনেত্রী ছিলেন তারা সবাই দেশ ছেড়ে ইউরোপ/ আমেরিকায় অভিবাসী হয়েছেন। বাকি যারা আছেন তারা পাশের দেশ ভারতে গিয়ে কাজ খুঁজছেন। আমাদের জয়া আহসান কোলকাতার অভিনেত্রীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে ভারতের ফিল্ম ফেয়ার এওয়ার্ড অর্জন করেন অথচ তার জন্য আমাদের দেশে কোন কাজ নেই। চমক হাসান নামে আমাদের দেশের খুব মেধাবী একটা ছেলে ছিল যে বিজ্ঞান, গণিত, যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়কে জনপ্রিয় করার জন্য অসাধারণ কিছু কাজ করেছে। তার ইউটিউবে ভিডিও আছে যেগুলো লাখ লাখ বার ভিউ হয়, একুশে বই মেলায় তার দারুণ কিছু বই বের হয় এবং তার লেখা ও সুর করা গানগুলি দর্শক মহলে বেশ প্রশংসিত হয়। আমি নিজেও তার গানের খুব ভক্ত। এই চমককে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রিকগ্নাইজ করল কে? না আমাদের সরকার না আমাদের প্রাইভেট সেক্টরের কোন প্রতিষ্ঠান কেউ তাকে ডাকলো না। তার সাথে যোগাযোগ করল ভারতের একজন সিনেমা প্রযোজক উনার পরবর্তী সিনেমায় মিউজিক ডিরেকশনের জন্য। হয়তো এ বছর কিংবা আগামী বছর চমকের সঙ্গীতায়োজনে কোলকাতায় একটা সিনেমা মুক্তি পাবে। এই হল অবস্থা। সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ভাষার মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করার একটা সর্বশেষ উদ্যোগ ছিল পহেলা বৈশাখকে ধুমধামে উদযাপন করা কিন্তু সেই উদ্যোগও মাঠে মারা গেছে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে ইসলাম বিরোধী কুফরি সংস্কৃতি বলে ইতিমধ্যে সমাজের মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
ধর্মীয় উন্মাদনা
আগে গ্রামে গ্রামে শীতের দিনে বাউল গান হত, মেলা হত, এখন তার বদলে হয় ওয়াজ মাহফিল। মাওলানাদের ঘৃণাবাচক বক্তব্য ইউটিউবের কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। মানুষ এখন আর ভালবাসতে পছন্দ করে না, ঘৃণা করতে পছন্দ করে। ক্রমাগত এইসব উগ্র ও অসহিষ্ণু বক্তব্যের প্রচারের ফলে এই দেশে একদল উন্মাদ জনতা(Angry Mob) তৈরি হয়েছে। তারা কোন কিছু যাচাই করে না, বাছাই করে না, যুক্তি চিন্তার ধার ধারে না, ধর্ম অবমাননা সংক্রান্ত কোন একটা গুজব রটা মাত্রই তারা উন্মাদ হয়ে যায়। উন্মাদ হয়ে তারা আক্রমণ করে মানুষের ঘর বাড়ি, লুট করে, ধর্ষণ করে, মানুষকে নৃশংসতম উপায়ে হত্যা করে। এই এংরি মবদের উৎপাত শুরু হয় ২০১২ সালে রামু বৌদ্ধ বিহার হামলার মাধ্যমে। এরপরে দিনাজপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জসহ দেশের প্রায় প্রতিটা জেলায় এদের কর্মকান্ড দিন দিন আরও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। যেহেতু রাষ্ট্র ও সরকার এই মানুষদের এবং তাদের পেছনে উষ্কানিদাতা নাটের গুরুদের কোন প্রকার বিচারের আওতায় নিয়ে আসে না, ফলে এদের ধ্বংসাত্মক ভূমিকা সামনের দিনে আরও বাড়বে বলেই প্রতীয়মান হয়।
স্বৈরাচারী শাসন
দেশে সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় চলছে তুমুল নৈরাজ্য। লুটপাট, দুর্নীতি, আর দুঃশাসন এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। একদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে আরেকদিকে সরকার তেল গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে সেই মূল্য স্ফীতিকে আরও কয়েক গুণ বর্ধিত করে দেয়। সরকারের একেকটা কলমের খোঁচায় গরীব মানুষ আরও বেশি গরীব হয়ে যায়, মধ্যবিত্ত নেমে যায় নিম্ন মধ্য বিত্তের কাতারে। জনগণ এই অব্যবস্থাপনায় হাঁসফাঁস করছে কিন্তু মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছে না। চরম অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসনে মানুষ তার রাগ ক্ষোভ প্রকাশ করার কোন স্বাভাবিক পথ খুঁজে পাচ্ছে না। দেশে কোন দায়িত্বশীল বিরোধীদল নেই, যারা আছে তারা গণ সম্পৃক্ত নয় কিংবা স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সৎ সাহস নাই। ফলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে এক গুমোট পরিবেশ, যেই বিষাক্ত পরিবেশে ধর্মীয় উগ্রতা ও অন্ধতা বেড়ে উঠে ছত্রাকের মত।
প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির বিভক্তি ও দূর্বলতা
প্রগতিশীল রাজনীতির ঝাণ্ডা ধারণ করা বামপন্থীরা এমিবার গতিতে নিজেদেরকে বিভক্ত করেন আর দূর্বল হয়ে পড়েন। ফলে তাদের কিছু বলা কিংবা না বলায় কিছু আসে যায় না। তাছাড়াও ইসলামী শক্তির এই উত্থানকে তারা আলাদা করে কোন সমস্যা মনে করেন না। সব রোগের এক অসুখ পুঁজিবাদ আর সব রোগের এক দাওয়াই রাষ্ট্র বিপ্লব, এর বাইরে তারা আর কিছু ভাবতে পারেন না। উদার গণতান্ত্রিকরা সব কথাই বলেন ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের আঁচ বাঁচিয়ে। রাষ্ট্রচিন্তা নামে এক নতুন সংগঠনের আত্ম প্রকাশ হল যার উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ বিভিন্ন বাম দল থেকে বের হয়ে আসা। সেই সংগঠন দেশের রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা কেমন হবে তা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিতে নারাজ। তারা রাষ্ট্র সংস্কার করতে চায়, সংবিধান সংশোধন করতে চায় কিন্তু সেই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকবে কিনা তা নিয়ে কোন স্পষ্ট বক্তব্য দিতে চায় না। আবার বেশ কিছু দিন ধরে বিশ্ব বিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় জোনায়েদ সাকি সাহেবকে সেদিন এক টকশো তে সঞ্চালক বহুবার রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম থাকা না থাকা নিয়ে তার বক্তব্য জানতে চাইলেন কিন্তু তিনি টানা ১৫ মিনিট বহু বহু কথা বলেও এই ব্যাপারে তার স্পষ্ট বক্তব্য প্রকাশ করলেন না। কারণ তিনি জানেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম থাকবে কি থাকবে না সেই ব্যাপারে কথা বলা মানে নিজের রাজনৈতিক কবর নিজেই খুঁড়ে ফেলা। ইসলাম এবং ইসলামী রাজনীতিকে মাইনাস করে কোন রাজনৈতিক বয়ানই এ দেশে আর গ্রহণযোগ্য হবে না।
প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনে ঢালাও বরাদ্দ
দেশের সেনাবাহিনীকে বছরের পর বছর সহস্র কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে খুশি রাখা হচ্ছে এবং সেনাবাহিনীর এই ব্যয় বছর বছর বাড়ানোও হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০০৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সামরিক খাতে ১২৩ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। সুইডেন-ভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট বা সিপ্রি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামরিক ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরেছে। গবেষণা সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে সামরিক খাতে ব্যয় ছিল প্রায় ছয় হাজার ছয়শ’ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৭ সালে সামরিক খাতে ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় আটাশ হাজার আটশত কোটি টাকা। গবেষণা সংস্থাটির হিসেবে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশে সামরিক খাতে ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ, যদিও সামরিক সক্ষমতা ও অস্ত্রপাতির হিসাবে মিয়ানমার বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ এগিয়ে। আর এই বছর ২০২১ সালে এই বরাদ্দের পরিমাণ সাইত্রিশ হাজার কোটি টাকা। নতুন নতুন আর্মি ক্যান্টনমেন্ট এবং আবাসন প্রকল্প ছাড়াও রয়েছে তাদের বহুবিধ ব্যবসা। সেনা কল্যাণ সংস্থার নামে এই বাহিনীর বর্তমান ও প্রাক্তন সদস্যদের রয়েছে লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা।
শুধু সেনাবাহিনী নয় সরকারের পুলিশ, প্রশাসন ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরকেও অনেক ধরণের সুযোগ সুবিধা দিয়ে খুশি করার প্রচেষ্টার প্রতিফলন প্রতি বছরের বাজেটে দেখা যায়। যেহেতু জনগণের সাথে এই সরকারের আর কোন দায়বদ্ধতা নেই, যেহেতু জনগণের উপর সরকারের কোন আস্থাও নেই তাই সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের উপরই সরকারকে নির্ভর করে তার শাসন কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।
বুদ্ধিজীবীদের চাটুকারিতা ও ইসলামিক বুদ্ধিজীবীর প্রভাব
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দুইটা ধারা ছিল। এক ধারার বুদ্ধিজীবীরা মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীন মত প্রকাশের পক্ষে কথা বলতেন। তারা গণতন্ত্র, নারী মুক্তি, সেক্যুলারিজম, ধর্ম মানা বা না মানার স্বাধীণতা ইত্যাদি মূল্যবোধের পক্ষে তাদের মত প্রকাশ করতেন। আরেক ধারার বুদ্ধিজীবীরা ইনিয়ে বিনিয়ে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার পক্ষে তাদের কলম চালাতেন। ইসলামের স্বর্ণযুগের স্মৃতি রোমন্থন কিংবা পুনর্জাগরণের মধুর স্বপ্নে তারা বিভোর ছিলেন। তাদের গল্প-কবিতা-প্রবন্ধে সে সকল বিষয়ই ফুটে উঠত। তবে প্রথম ধারার বুদ্ধিজীবীরাই মূলধারা ছিলেন, তাদেরকে ঘিরেই আবর্তিত হত যাবতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ড।
এখন আর সেই দিন নেই। এখন সুঁইকে সুঁই আর কোদালকে কোদাল বলতে পারা বুদ্ধিজীবী কেউ অবশিষ্ট নেই। যে বা যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিয়োজিত তাদের মধ্যে যেমন সৃজনশীল ও মননশীল সৃষ্ঠিকর্মের চর্চা কমে যাচ্ছে, তেমনি তার সাথে পাল্লা দিয়ে সরকার প্রধানের পায়ে পায়ে ঘুর ঘুর করা এবং অর্থ সম্মান লাভের আশায় তার স্তাবকতা করার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। অপরদিকে ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কতিপয় অসাধু লোক ইসলামপন্থী শিক্ষা সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সলিমুল্লাহ খান, আসিফ নজরুল, পিনাকী ভট্টাচার্য এইসব বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাদের ফ্যান ফলোয়ারদের সংখ্যাও কম নয়। প্রগতিশীল ঘরানার অনেক তরুণ যুবকদের তারা প্রভাবিত করেন।
জনগণের মধ্যে ইসলামী সংস্কৃতি ও অনুশাসনের প্রতি আগ্রহ
এই জিনিসটা যত দিন যাচ্ছে ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের মধ্যবিত্ত নারী সমাজ হিজাব এবং বোরখাকে আপন করে নিয়েছে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বোরখা ও হিজাব পরিহিতাদের সংখ্যা চল্লিশোর্ধ সচেতন নাগরিকদের হতবাক করে দিচ্ছে। তারা তাদের অতীত অভিজ্ঞতার সাথে এই দৃশ্য মিলাতে পারছেন না। কেননা, সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে হিজাব ও বোরখার ব্যবহারের এই রেভলিউশন মাত্র দুই দশকের মধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। পুরুষরাও পিছিয়ে নেই। চোর হোক, পুলিশ হোক, ঘুষখোর হোক, দুর্নীতিবাজ হোক, শিল্পী হোক, খেলোয়াড় হোক, যেই হোক না কেন তাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, কথায় কথায় আলহামদুলিল্লাহ্ সোবহানাল্লাহ ইত্যাদি উচ্চারণ করার মাত্রা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। ধর্মের নৈতিক বিচারের ধারে কাছেও না গিয়ে শুধু আচার আচরণে ধর্মকে আঁকড়ে ধরার প্রাণান্তকর চেষ্টা বেশ ভালোই চোখে পড়ে। আগে মফঃস্বলের পাড়া মহল্লাগুলিতে একেকটা ক্লাব ছিল, পাঠাগার ছিল, সেই পাঠাগার কিংবা ক্লাবকে কেন্দ্র করে তরুণ যুবকদের মধ্যে খেলাধুলা কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড অনুষ্ঠিত হত কিন্তু এখন আর এগুলো চোখে পড়ে না। খুব সচেতনভাবেই মানুষ এগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
তাহলে এই সমস্ত কর্মকান্ডকে যদি আমরা সংক্ষেপে তালিকাবদ্ধ করি তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এমন –
১। সাধারণ শিক্ষার অবমূল্যায়ন
২। শিল্প সংস্কৃতি ধ্বংস
৩। ধর্মীয় উন্মাদনা
৪। দীর্ঘ দিনব্যাপী স্বৈরাচারী শাসন
৫। প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির বিভক্তি ও দূর্বলতা
৬। বুদ্ধিজীবীদের মোসাহেবে পরিণত হওয়া কিংবা ইসলামী চিন্তা ও চেতনার প্রসারে ভূমিকা রাখা
৭। জনগণের মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় ধর্মীয় অনুশাসন ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ তৈরি হওয়া
এই সকল ইনডিকেটর এটাই দিক নির্দেশ করে যে বাংলাদেশে খুব জোরেশোরেই একটা ধর্মীয় বিপ্লব সম্পন্ন হচ্ছে। এখন এই বিপ্লব তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করার অর্থাৎ, সকলের চোখের সামনে প্রকাশিত হওয়ার দুইটা মডেল আছে। বুঝার সুবিধার জন্য আমরা এটাকে পাকিস্তান মডেল এবং ইরান মডেল হিসাবে আখ্যায়িত করতে পারি। পাকিস্তান মডেল হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে রাজনৈতিক মাফিয়াদের নেতৃত্বে একটু একটু করে আইন প্রণয়ন কিংবা পরিবর্তন করে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সামাজিক স্পেসে ধর্মকে ইঞ্জেক্ট করে পুরো রাষ্ট্র এবং সমাজের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দিয়ে একটা সময় সেই রাষ্ট্রকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়া।এই মডেলের ইসলামিক রাষ্ট্রের সরকার প্রধান কিংবা মন্ত্রী পরিষদে বড় বড় আলেম উলামার বদলে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দেখা যায় তবে জনগণের মন, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে আলেম ও মাফিয়ারা যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। আর ইরান মডেল হচ্ছে বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো, তার সেনাবাহিনী, প্রশাসন, পুলিশ ফোর্সকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যাপক গণ আন্দোলন ও বিক্ষোভ সংগঠিত করে তাদেরকে অপসারণ ও নিশ্চিনহ করে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আয়োজনে একটা ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়া। কোন মডেলে এই দেশে ইসলামিক বিপ্লব চূড়ান্ত হবে তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও এখন সত্য হচ্ছে যে, এই দেশ আজ অথবা কাল ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশেই রূপান্তরিত হবে। বাংলাদেশকে আধুনিক, সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যহীন সমাজের দিকে এগিয়ে নেয়ার আশা আপাতত ছাড়তে হবে। ।
এখন পাকিস্তান কিংবা ইরান হওয়ার সমস্যা কি তা ভেঙ্গে বলার প্রয়োজন নেই তবে মোটা দাগে এটাই বলা যায়, পাকিস্তান/ ইরান হওয়ার জরিমানা চরমভাবে প্রদান করবে এ দেশের নারী, ভিন্ন ধর্মী জনগণ এবং আধুনিক সেক্যুলার ভাবধারার সংখ্যালঘু মুসলমানেরা। ইসলামিক রেভলিউশনারী শক্তিগুলো যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান করবে তখন সকল নারীদের বাধ্যতামূলক পুরুষের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হবে, ব্লাসফেমি টাইপের আইন পাশ করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও মাজহাবিদের উপর চূড়ান্ত রকম নিপীড়ন চালানো হবে, উদার ও গণতন্ত্রমণা মানুষদের ধরে ধরে জেলে পাঠানো হবে কিংবা দেশছাড়া করা হবে। (এটা বেশ কিছুদিন ধরে এই দেশে হয়ে আসছে। বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোন অংশেই ব্লাসফেমি আইনের চেয়ে কম ক্ষতিকর বলে মনে হচ্ছে না।) তবে সবচেয়ে নিকৃষ্ট আশঙ্কা হচ্ছে যে, এই শক্তিগুলো তাদের প্রতিপক্ষের উপর নির্বিচার গণহত্যা চালানো শুরু করবে। কেননা এই ভূখণ্ডের ইসলামিক উগ্রপন্থীদের দ্বারা বেশ কয়েকটি গণহত্যা, গণধর্ষণ ও গণনিপীড়নের ইতিহাস রয়েছে। কাজেই সময় খুব বেশি নেই, হয়তো দুই, তিন কিংবা পাঁচ বছরের মধ্যেই এই চলমান ইসলামী বিপ্লব তার চূড়ায় আরোহণ করবে। এখন এই সময়ে যারা নিজেদেরকে প্রগতির পক্ষের শক্তি বলে মনে করে তাদের ভূমিকা কি হবে? কিভাবে তারা নিজেদেরকে রক্ষা করবে? কিভাবে সম্ভাব্য গণহত্যা এবং গণনিপীড়নকে ঠেকানোর আয়োজন করবে? তারা কি তা ভাবছেন?
আপনার মতামত জানানঃ