সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার দশহালিয়ায় স্বেচ্ছায় বাঁধ মেরামতে নিয়োজিত মানুষের রোষের মুখে পড়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে স্থানীয়রা ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত করার সময় সেখানে যান স্থানীয় সংসদ সদস্য। তাকে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বাঁধ মেরামতকারীরা। একপর্যায়ে জনপ্রতিনিধির দিকে কাদা ছুড়তে থাকেন তারা। তখন সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হন ওই সংসদ সদস্য। যদিও পরে আবার ফিরে আসেন পুলিশি পাহারায়।
আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, ইয়াসের পর ওই এলাকার বাঁধ ভেঙে মহারাজপুর ও পাশের বাগালী ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে সাগরের লোনাপানিতে। ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে গত বুধবার ভেঙে যাওয়া ওই বাঁধ এখনো মেরামত করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে নিয়মিত জোয়ারভাটা আসা-যাওয়া করছে গ্রামগুলোর মধ্য দিয়ে। ঘূর্ণিঝড় আইলার দীর্ঘ এক যুগ পর আবার এমন দুর্ভোগে পড়েছে। চার দিন ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত করছেন এলাকার মানুষ।
আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাংসদ একটি ট্রলারে করে ওই ভাঙা বাঁধের স্থানে যান। যখনই তার ট্রলারটি ঘাটে ভিড়তে যায়, তখনই কাঁদা ছুড়তে শুরু করেন স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করা মানুষগুলো। বারবার মাইকে ঘোষণা করেও তাদের নিবৃত্ত করা যায়নি। প্রায় ১০ মিনিট বৃষ্টির মতো কাদা ছুড়ে মারার একপর্যায়ে ট্রলারটি পিছু হটে নদীর অপর পাড়ে চলে যায়। প্রায় আধা ঘণ্টা পর কাজ করতে থাকা মানুষকে শান্ত করা হলে আবার সাংসদ সেই ভাঙা বাঁধের কাছে যান।
এরপর এমপি উপস্থিত এলাকাবাসীর উদ্দেশে মাইকে বক্তৃতা করেন। এরপর তিনি বাঁধ মেরামতের কাজে নামলে, অধিকাংশ স্বেচ্ছাশ্রমিক বাঁধ মেরামতের কাজ ফেলে চলে যান।
প্রত্যক্ষদর্শী মহারাজপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর দেয়াড়া ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য বাবুল হোসেন বলেন, এমপি সাহেব আসলেন ট্রলারে করে। তখন স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে আসা জনগণ তার (এমপি) আসার প্রয়োজন নেই বলে কাদা ছুড়তে থাকেন।
তিনি বলেন, একপর্যায়ে পুলিশ ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরে এমপি বাঁধের কাজ শুরু করতে গেলে অধিকাংশ জনগণ কাজ ছেড়ে চলে যান। তা না হলে আজ বাঁধের কাজ শেষ হয়ে যেত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বেচ্ছাশ্রমে আসা একাধিক স্থানীয় ব্যক্তি বলেন, বাঁধের কাজ আসলেই এমপি তার আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে কাজ করান। ফলে কাজ ভালো হয় না। একটু ঝড়-বৃষ্টি হলেই বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ জনগণ। সে কারণে এমপির ওপর উপজেলার অধিকাংশ মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। তার প্রকাশ ঘটেছে আজ।
তবে সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান দাবি করেছেন, টেকসই বেড়িবাঁধের দাবিতে মানুষ বিক্ষোভ করেছে, কিন্তু তার ট্রলারে কাদা ছুড়ে মারা হয়নি।
স্থানীয়দের দাবিকে যৌক্তিক বলে সংসদ সদস্য বলেন, বারবার বাঁধ ভাঙে আর স্বেচ্ছাশ্রমে তাদের কাজ করতে হয়। এ কারণে জনপ্রতিনিধির ওপর তাদের ক্ষোভ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণে একটি অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার অবসান হয়। এমপি সাহের বাঁধের কাজের স্থানেই আছেন।
এমপি’র গায়ে কাদা ছোড়ার ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ১৭ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, বাঁধের কাছে কেবল ট্রলার ভিড়েছে, এমন সময় এমপিকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো কাদা ছোড়া হচ্ছে। টিকতে না পেরে ট্রলার ফিরে যাচ্ছে।
মাইকে উত্তেজিত মানুষকে শান্ত হওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন একজন। সাংসদের ট্রলার ফিরে যেতে দেখে হাততালি দেওয়ার শব্দও শোনা যায় ভিডিওতে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একে তো বন্যাপ্রবণ, তার উপর প্রতিবছর দুই তিনটা ঘূর্ণিঝড়ে নাস্তানাবুদ দেশ। উপকূল আর নিম্নাঞ্চলের মানুষদের জন্য বাঁধ তাই বেঁচে থাকার অবলম্বন। তবে দেশের বাঁধগুলো ষাটোর্ধ বৃদ্ধের মতো নাজুক। শক্তিহীন। ঝুঁকিপূর্ণ। আর তা পুনর্নির্মাণে কোন প্রকার পদক্ষেপ নেই সরকারের। মেম্বার চেয়ারম্যানরা সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাটে ব্যস্ত। ভুগতে হয় দরিদ্র মানুষগুলোকে। প্রতিবার ঘূর্ণিঝড়ে বন্যায় সর্বস্ব হারায় তারা। আবার উঠে দাঁড়ায়। আবার ভাঙে। ভাঙাগড়ার তাদের এই জীবনে ভোট দেয়া ছাড়া আর কোন অধিকার তাদের নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপকূলের দুর্যোগ ও বিপর্যয় মোকাবেলায় অনেক প্রকৃতিনির্ভর ও লোকায়ত প্রক্রিয়া আগে ছিল। কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেছে, যা খুঁজে বের করাও দরকার। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর জোরালোভাবে উপকূলীয় বাঁধ ব্যবস্থার পুনর্বাসনের দাবি ওঠে। যে দাবি মূলত দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা।
তারা বলেন, উপকূলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামত করা হোক। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়েছে, সে কারণে বাঁধ মজবুত করার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধের উচ্চতাও বাড়াতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে, যাতে জোয়ার যত বেশিই হোক, বাঁধ উপচিয়ে যেন পানি আসতে না পারে। কিন্তু উপকূলবাসীর আবেদন, নিবেদন, দাবি কর্তৃপক্ষের কানে কতটা প্রবেশ করে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তারা বলেন, সাধারণ মানুষ যখন বুঝতে পেরেছে মহাবিপদ আসন্ন, তখনই তারা কোদাল হাতে, মাটির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বাঁধ রক্ষায় নেমেছে। হয়তো সফল হয়েছে, অথবা হয়নি, প্রাণপণ চেষ্টা তো করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৮
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ