ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারে পূর্ব সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে একে একে চারটি মৃত হরিণ লোকালয়ে ভেসে এসেছে। আর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় লোকালয়ে পাওয়া গেছে জীবিত দুটি হরিণ। এদিকে নিঝুম দ্বীপের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বেশকিছু সংখ্যক হরিণ ভেসে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে দুটি হরিণ উপজেলার চরকিং ইউনিয়নের লোকালয় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
বনবিভাগের আশঙ্কা, পানিতে ডুবে সুন্দরবনে আরও কিছু বন্যপ্রাণী মারা গিয়ে থাকতে পারে।
বনবিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার ও বৃহস্পতিবার সুন্দরবনের কচিখালী অভয়ারণ্য ও দুবলার চর থেকে দুটি, শরণখোলা উপজেলার সাউথখালি ইউনিয়নের তাফালবাড়ি গ্রাম থেকে একটি ও রায়েন্দা ইউনিয়নের রাজেশ্বর গ্রাম থেকে একটি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে।
বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারে প্রায় পাঁচ থেকে ছয়ফুট পানি উঠে যায় সুন্দরবনে। সেই পানিতে ডুবেই হরিণগুলো মারা গেছে।
তিনি বলেন, ‘এরইমধ্যে চারটি মৃত ও দুটি জীবিত হরিণ আমরা উদ্ধার করেছি।’
বন বিভাগ ও পিরোজপুর স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আজ সকাল ছয়টার দিকে উপজেলার উলুবাড়িয়া গ্রামের নজরুল ইসলাম ব্যাপারীর বাড়ির সামনের বাগানে দুটি চিত্রা হরিণ দেখতে পান কয়েকজন তরুণ। এ সময় তারা হরিণ দুটিকে তাড়া করেন। তাড়া খেয়ে একটি হরিণ উলুবাড়িয়া গ্রামের মো. রিয়াজের বাড়িতে ঢুকে পড়লে তা আটক করা হয়। অপর হরিণটি পাশের গোলবুনিয়া গ্রামের ধানখেতে চলে যায়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে স্থানীয় লোকজন ধানখেত থেকে হরিণটি উদ্ধার করেন।
নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ উপজেলা বন বিভাগের সহকারী বন কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, বুধবার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার চরকিং ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাইশ নম্বর এলাকায় লোকালয়ে স্থানীয়রা ভিজে যাওয়া একটি হরিণ দেখতে পান। প্রায় একই সময়ে কাছাকাছি কিল্লার বাজার এলাকায় আরও একটি হরিণ পাওয়া যায়। হরিণ দুটোকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা তাৎক্ষণিক বন বিভাগে খবর দেন।
বন বিভাগের নিঝুম দ্বীপ বিটের কর্মকর্তা মাসুদ রায়হান বলেন, বুধবার ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট অস্বাভাবিক জোয়ারে নিঝুম দ্বীপের হরিণগুলো বেশ বিপাকে পড়ে। অধিকাংশ হরিণের আবাসস্থল ডুবে যায়। এ সময় অনেক হরিণ মানুষজনের বসত ভিটায়, সড়কে ও বনের ভেতর খনন করা পুকুরের পাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কিছু হরিণ জোয়ারের পানির তোড়ে অন্য এলাকায় ভেসে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করে বন বিভাগের জাহাজমারা রেঞ্জের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, নিঝুম দ্বীপে হরিণের সঠিক সংখ্যা বলা মুশকিল। তবে সেখানে পাঁচ থেকে ছয় হাজার হরিণ থাকতে পারে। অতিরিক্ত জোয়ারে এসব হরিণ কিছুটা সংকটের মধ্যে পড়ে। অবশ্য এরই মধ্যে বনের ভেতরে বেশ কয়েকটি পুকুর খনন করা হয়েছে। যাতে জোয়ারের সময় সেগুলোর পাড়ে হরিণ আশ্রয় নিতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে নিঝুম দ্বীপের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বেশকিছু সংখ্যক হরিণ ভেসে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিঝুমদ্বীপে উঁচু জায়গা না থাকায় জোয়ার বা ঝড়ের সময় উদ্যানে থাকা হরিণের জীবন বিপন্নের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, জোয়ার থেকে রক্ষার জন্য নিঝুমদ্বীপের হরিণের জন্য উুঁচু কোনও মাটির কিল্লা নেই। তাই স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে একটু বেশি পানি প্রবাহিত হলে জোয়ারে হরিণগুলো ভেসে যায়। যেকারণে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের জোয়ারের অতিরিক্ত পানির সঙ্গে দ্বীপের বনাঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক হরিণ ভেসে গেছে।
বন বিভাগের জাহাজমারা রেঞ্জের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, জোয়ারের কারণে কিছু হরিণ ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। আমরা বিভিন্ন সময় হরিণের জন্য উুঁচু কিল্লা নির্মাণের দাবি করেছি। কিন্তু যখন কোনও বন্যা আসে শুধু তখনই এগুলো নিয়ে একটু কথা ওঠে। তারপর আর কেউ খোঁজ রাখেন না।
বনবিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ২০০৮ সালের দিকে নিঝুমদ্বীপে ৪০ হাজারের মতো হরিণ ছিল। কিন্তু যেখানে হরিণের এই সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়ার কথা, সেখানে তা এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র চার থেকে পাঁচ হাজারে।
বন বিভাগের দাবি, ব্যাপকহারে বাগান ধ্বংস, জনবসতি গড়া ও ইউনিয়ন পরিষদ ঘোষণা করে এর স্বকীয়তা নষ্ট করার কারণে দ্বীপের এমন পরিণতি হয়েছে। তাছাড়া হরিণের নিরাপদ আশ্রয়স্থল গড়ে না তোলার কারণে হরিণগুলোর এমন পরিণতি হচ্ছে।
এদিকে জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের ১৯টি জেটি, ১০টি অফিস, চারটি জলোযান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বনের দুর্গম এলাকায় সবার সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিকভাবে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, সে অনুযায়ী ইতোমধ্যে বনের বিভিন্ন এলাকা থেকে চারটি মৃত ও একটি জীবিত হরিণ উদ্ধার হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পূর্ব বনবিভাগের ১৯টি জেটি, ৯টি পুকুর, ১০ অফিস ও স্টেশনে টিনের চালা উড়ে গেছে, ভেঙে গেছে দুটি টাওয়ার, ২৪টি পাটাতনের রাস্তা ও নষ্ট হয়েছে ছয়টি জলযান।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে দেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নির্ধারণে বনবিভাগ চারটি পৃথক কমিটি গঠন করেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত বনবিভাগের চারটি রেঞ্জ এলাকা। যার দুটি বাগেরহাটে অবস্থিত।
ইতোমধ্যে সুন্দরবনের পূর্ব বনবিভাগের অন্তর্গত শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের ক্ষতি নিরূপণে কাজ শুরু করেছেন কমিটির কর্মকর্তারা। সুন্দরবনের খুলনা জেলার নলিয়ান ও সাতক্ষীরা জেলার বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জেও একইভাবে সেখানকার ক্ষতি নিরূপণে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার সকালে বনের অনেক এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে। তবে দুপুরে জোয়ারের সময়ে আবারও পানিবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
পূর্ণিমার জোয়ার ও বাতাসের গতিবেগ থাকায় বনসংলগ্ন নদী-খাল পরিপূর্ণ রয়েছে। তবে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী কেন্দ্রের কুমির, হরিণ ও কচ্ছপ নিরাপদে রয়েছে বলে জানান তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ