অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম শুরু করলেও বাংলাদেশে আঘাত হানার সম্ভাবনা কম। তবে পূর্ণিমা আর ঝুঁকিপূর্ণ ও নিচু বেড়িবাঁধ ভোগাবে বাংলাদেশকে। ইতিমধ্যেই উপকূলের বহু অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফসলি জমি, মাছের ঘের পানির তলে বিলীন হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে মানুষ। কাগজে কলমে ঘূর্ণি বাতাসে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও কম হলেও নিম্নাঞ্চলের মানুষদের জীবনে আরও একটা বিপর্যয় নিয়ে আসতে চলেছে ইয়াস। সরকারের অব্যবস্থাপনা, বাঁধ নির্মাণে গোজামিল যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগেই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দীর্ঘদিন যাবত।
বাংলাদেশকে ভোগাবে পূর্ণিমা
পূর্ণিমা মানেই সাগর আর উপকূলে পানির বিশৃঙ্খল আচরণ। জোয়ার থাকবে। স্বাভাবিকের চেয়ে পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে কয়েক ফুট। এর সঙ্গে যদি ঝড়ো হাওয়া ও ঘূর্ণিঝড়ের থাকে তাহলে তো কথাই নেই। ওই সময় সাগর ভয়ানক রূপ নেয়।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় এখন অতি প্রবল আকার ধারণ করেছে। সাগরও রয়েছে বিক্ষুব্ধ। যদিও ঘূর্ণিঝড়টির মূল নিশানা থাকবে ভারতের উত্তর উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। তারপরেও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন, পূর্ণিমা হওয়ার কারণেই বাংলাদেশ বেশি ভুগবে।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাস প্রায় ৫০০ কিলোমিটারের এর মতো। আমাদের পায়রা বন্দর যদি ধরি তাহলে এর দূরত্ব থাকবে প্রায় ২৮০ কিলোমিটার। ফলে কিছু অংশ বাংলাদেশের ভেতরে বা অগ্রভাগে পরবে। এসব এলাকায় দমকা হওয়াসহ ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাবে।
রশিদ বলেন, জোয়ার আর পূর্ণিমার কারণে ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পূর্ণিমার প্রভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুট অধিক উচ্চতার জোয়ারে প্লাবিত হতে পারে। এর ফলে এসব এলাকায় জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে পূর্ণিমার সময়ে বাংলাদেশে একটি ঘূর্ণিঝড় হয়। এতে অনেক জান-মালের ক্ষতি হয়। সুতরাং পূর্ণিমা বড় সমস্যা। এছাড়াও অতীতের কয়েকটা ঘূর্ণিঝড় পূর্ণিমার সময় না হওয়ায় বেশ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে।
জেটি বিধ্বস্ত, ভাঙছে রাস্তাঘাট
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে প্রবল জোয়ারের পানিতে কক্সবাজারের টেকনাফের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের একমাত্র জেটিটি বিধ্বস্ত হয়েছে। এই জেটি দিয়ে পর্যটকসহ দ্বীপের বাসিন্দারা যাতায়াত করতেন।
এছাড়াও উপড়ে পড়েছে গাছপালা। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে শঙ্কিত দ্বীপের বাসিন্দারা।
বুধবার (২৬ মে) সকাল থেকে ঝোড়ো হাওয়া ও বৃষ্টি বয়ে যাচ্ছে। তবে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে দ্বীপের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকের অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু গাছপালা উপড়ে গেছে। রাস্তাঘাট ভাঙছে। আর প্রবল জোয়ারের পানিতে বালিয়াড়িতে থাকা পাঁচটি ট্রলার ভেঙে গেছে। এছাড়াও প্রবল জোয়ারের পানিতে জেটিটি বিধ্বস্ত হয়েছে।
কোস্টগার্ড সেন্টমার্টিন স্টেশনের ইনচার্জ লে. কমান্ডার রাসেল মিয়া বলেন, দ্বীপে সব মিলিয়ে বাসিন্দা রয়েছে ১০ হাজার ২৬ জন। দ্বীপের হোটেল, রিসোর্ট, স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ মিলে ৩০টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে ছয় হাজার মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
‘এভাবে চলতে থাকলে বাঁধ থাকবে না’
‘এভাবে চলতে থাকলে বাঁধ থাকবে না। পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছে না। নদীতে যেভাবে ঢেউ চলছে সেটি যদি টানা দুই ঘণ্টা এভাবে চলতে থাকে তাহলে উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ থাকবে না। কী করবো এখন’ বলেন সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদুল হক।
বুধবার (২৬ মে) বেলা ১১টার পর থেকে উপকূলের নদীগুলোতে ২-৩ ফুট উঁচু ঢেউ শুরু হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার নীলডুমুর এলাকায় পাকা সড়ক উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। বিজিবি সদস্যরা ও গ্রামবাসী মিলে তাৎক্ষণিক বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছে।
“আমাদের এখানের বাঁধ অনেক নিচু। এ বাঁধ উঁচু করার জন্য গত পাঁচ বছর ধরে মেম্বার-চেয়ারম্যানের পা ধরা বাদে বাকি সব কিছু করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।”
অপরদিকে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের মান্নানের পাইপ কল এলাকায় জোয়ারের বেগে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ উপচে পানি ঢুকতে শুরু করেছে বলে জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম।
বেড়িবাঁধ ভেঙে ফসলি জমি, মাছের ঘের পানিতে
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে পটুয়াখালীতে নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ফসলি জমি, মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে।
সদর উপজেলার ছোট বিঘাই ইউনিয়নের ভাজনা গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা আবদুর রশিদ বলেন, আমাদের গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে সব শেষ করে দিয়েছে। আমার মরিচখেতসহ দু’টি মাছের ঘেরের লাখ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।
পটুয়াখালী আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মো. মাসুদ রানা বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ৩ মিলিমিটার বেগে বাতাস বইছে। পায়রায় ৩ নম্বর সংকেত রয়েছে। দুপুরে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস উপকূলে আঘাত হানতে পারে।
নিচু বাঁধ, লক্ষাধিক পরিবার পানিবন্দি
পূর্ণিমা ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে সৃষ্ট উঁচু জোয়ারে বরগুনার লক্ষাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। স্বল্প উচ্চতা ও ভাঙা বেড়িবাঁধই এ দুর্ভোগের কারণ বলে জানা যায়।
মঙ্গলবার (২৫ মে) সন্ধ্যা ছয়টার দিকে উপকূলীয় নদ-নদীতে জোয়ার শুরু হয়। যা চলে একটানা রাত সোয়া ১১টা পর্যন্ত। এ সময় বরগুনার নদ-নদীতে পানির উচ্চতা হয় ৩.৫৮ মিটার। যা বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে বরগুনার অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়।
গ্রামবাসী নূরজাহান বেগম (৬০) বলেন, কোনোরকমে সাঁতার কেটে রাস্তায় উঠেছি। পানির স্রোতে ঘরের চাল-ডালসহ যা ছিল সব ভাসে গেছে। আমি গরিব মানুষ, বাড়িতে কয়েকটা হাঁস-মুরগি ছিল, তাও সব ভেসে গেছে।
সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমাদের এখানের বাঁধ অনেক নিচু। এ বাঁধ উঁচু করার জন্য গত পাঁচ বছর ধরে মেম্বার-চেয়ারম্যানের পা ধরা বাদে বাকি সব কিছু করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। গত পাঁচ বছরে এই বাঁধের উপর এক ইঞ্চি মাটি কেউ দেয়নি।
ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ আরো ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ও ভরা পূর্ণিমায় খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে জোয়ারে পানি স্বাভাবিকের থেকে প্রায় প্রায় ৩ ফুট বেড়েছে। জোয়ারের পানির তেড়ে কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছার বিভিন্ন এলাকায় ভাঙছে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ।
স্থানীয়রা ঝুকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ রক্ষার প্রাণান্তর চেষ্টা করলেও তা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
জানা যায়, সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপ উপজেলার পশুর, চুনকুঁড়ি, ঢাকি, শিবসা, কাজিবাছা, ঝপঝপিয়া ও মাঙ্গা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে আড়াইফুট থেকে ৩ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
এতে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষের মধ্যে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা বিরাজ করছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাঁধ রক্ষায় উদ্যোগ নেই
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারের তোড়ে নোয়াখালীর হাতিয়ার তুফানিয়া গ্রামের বেড়িবাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা রক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে আজ বুধবার জোয়ারের পানিতে ওই বেড়িবাঁধ পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জোয়ারে তুফানিয়া গ্রামের ইরাক মেম্বারের বাড়িসংলগ্ন এলাকায় সম্প্রতি নির্মিত একটি বেড়িবাঁধের এক পাশের কমপক্ষে ৩০-৪০ ফুট জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এক দিন পার হলেও পাউবো কিংবা উপজেলা প্রশাসনের কেউ বেড়িবাঁধটি সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
সূত্র জানায়, গতকাল দিনের তুলনায় রাতে জোয়ারের তীব্রতা কিছুটা কম ছিল। সে কারণে বেড়িবাঁধটি সকাল নাগাদ রক্ষা পেয়েছে। সকালে ভাটায় পানি নেমে যাওয়ায় বাঁধের ক্ষতির চিহ্ন ভেসে ওঠে।
আজ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ও পূর্ণিমার প্রভাবে ব্যাপক জোয়ার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাঁধটি সংস্কার করা না হলে বাঁধটি ভেঙে ওই এলাকা পুরোটা প্লাবিত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একে তো বন্যাপ্রবণ, তার উপর প্রতিবছর দুই তিনটা ঘূর্ণিঝড়ে নাস্তানাবুদ দেশ। উপকূল আর নিম্নাঞ্চলের মানুষদের জন্য বাঁধ তাই বেঁচে থাকার অবলম্বন। তবে দেশের বাঁধগুলো ষাটোর্ধ বৃদ্ধের মতো নাজুক। শক্তিহীন। ঝুঁকিপূর্ণ। আর তা পুনর্নির্মাণে কোন প্রকার পদক্ষেপ নেই সরকারের। মেম্বার চেয়ারম্যানরা সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাটে ব্যস্ত। ভুগতে হয় দরিদ্র মানুষগুলোকে। প্রতিবার ঘূর্ণিঝড়ে বন্যায় সর্বস্ব হারায় তারা। আবার উঠে দাঁড়ায়। আবার ভাঙে। ভাঙাগড়ার তাদের এই জীবনে ভোট দেয়া ছাড়া আর কোন অধিকার তাদের নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৩৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ