রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুরের পর প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে।
আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার একটু পরে রোজিনা ইসলামকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে নেওয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম তার রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আগামী বৃহস্পতিবার তার জামিনের শুনানি হতে পারে।
মঙ্গলবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসীমের আদালত এ আদেশ দেন। আদালতের সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সরকারি নথি ‘চুরির চেষ্টার’ অভিযোগে অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনের মামলায় গ্রেফতার রোজিনাকে এদিন আদালতে হাজির করেন শাহবাগ থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আরিফুর রহমান সর্দার। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার জামিনের আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে রিমান্ড নামঞ্জুর করে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পাশাপাশি জামিনের বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ২০ মে দিন ধার্য করেছেন আদালত।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদালতে রোজিনার পক্ষে শুনানি করেন প্রথম আলোর নিয়োজিত আইনজীবী এহসানুল হক সামাজি, আশরাফ উল আলম, প্রশান্ত কুমার কর্মকার। এ ছাড়া, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পক্ষে আইনজীবী আব্দুর রশীদ, ব্লাস্টের পক্ষে আইনজীবী মশিউর রহমান এবং আইনজীবী সুমন কুমার রায় শুনানিতে ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে সেখানে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
রাত সাড়ে আটটার দিকে পুলিশ তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। রাত পৌনে ১২টার দিকে পুলিশ জানায়, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়েছে। তাকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
রোজিনার বিরুদ্ধে নথি সরানোর অভিযোগ
অফিশিয়াল সিক্রেক্টস অ্যাক্টে করা মামলায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে ৬২ পৃষ্ঠার নথি সরানোর অভিযোগ করা হয়েছে।
মামলার এজাহারের জব্দ তালিকায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষ থেকে চুরি হওয়া ৬২ পৃষ্ঠার নথি উদ্ধার দেখানো হয়েছে।
জব্দ তালিকায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন সেট (যার একটি স্যামসাং গ্যালাক্সি জি এস টোয়েন্টি আলট্রা লাইট, আরেকটি আইফোন সেভেন প্লাস) ও দুটি পিআইডি কার্ড জব্দমূলে উদ্ধার দেখিয়ে মঙ্গলবার সকালে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
নথি নিয়ে রমনা জোনের উপকমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি পুলিশের দেখার বিষয় না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যারা দিয়েছেন, তাদের বিষয়। তারা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের কাছ থেকে উদ্ধার করেছে, মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছে, পরে আবার তাদের জিম্মায় নিয়ে গেছে উদ্ধার হওয়া নথিগুলো। আদালত চাইলে তারা আবার দিতে বাধ্য থাকবেন।’
৬২ পাতার নথি কী বিষয়ক, জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এটা পড়ে দেখিনি। এটা আমরা বুঝবও না। আসলেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার মতো তথ্য আছে কি না, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন।’
রোজিনা ইসলাম সোমবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে তাকে পাঁচ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন সেখানকার কর্মকর্তারা। রাতে তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির অভিযোগে মামলা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে, এই গণমাধ্যমকর্মী রাষ্ট্রীয় কিছু গোপন নথি সরিয়েছেন; কিছু নথির ছবি তুলেছেন। এগুলো প্রকাশ হলে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারত। নথিগুলো ছিল টিকা ক্রয়-সংক্রান্ত।
অভিযোগে বলা হয়, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের টিকা ক্রয়-সংক্রান্ত আলোচনা চলছে। এর খসড়া সমঝোতা স্মারক ও নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট প্রণয়নকাজ চলছে। সমঝোতা স্মারক নিয়ে পক্ষদ্বয়ের মধ্যে প্রতিনিয়ত পত্র ও ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ হচ্ছে। সেখানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত।
বলা হয়, বিকেল দুইটা ৫৫ মিনিটে রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে সচিবের একান্ত সচিবের দপ্তরে ঢোকেন। তখন একান্ত সচিব দাপ্তরিক কাজে সচিবের কক্ষে অবস্থান করছিলেন। সে সময় রোজিনা ইসলাম দাপ্তরিক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র শরীরের বিভিন্ন স্থানে লুকানোর পাশাপাশি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তোলেন।
সে সময় সচিবের দপ্তরে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য মিজানুর রহমান খান বিষয়টি দেখতে পেয়ে রোজিনাকে বাধা দেন। আর নির্ধারিত কর্মকর্তার অনুপস্থিতে তিনি ওই কক্ষে কী করছেন, তা জানতে চান। এ সময় রোজিনা নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেন।
অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেছা বেগম তল্লাশি করে রোজিনার কাছ থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কাজগপত্র এবং নথির ছবি সম্বলিত মোবাইল উদ্ধার করেন।
রোজিনার বিরুদ্ধে মামলার সাজা তিন বছর
রাষ্ট্রীয় গোপনীয় নথি চুরির অভিযোগ এনে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব ধারায় মামলা হয়েছে, তাতে তার সর্বোচ্চ তিন বছরের সাজা হতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
এই মামলাটি জামিনযোগ্য বলেও জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেই এর বিচার হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মামলাটিতে মোট চারটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ছাড়াও অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারা যুক্ত করা হয়েছে।
৩৭৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি চুরি করে, তবে সে ব্যক্তি তিন বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।
৪১১ ধারায়ও একই ধরনের কথা বলা আছে।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, এই ধারায়ও সর্বোচ্চ সাজা আছে তিন বছরের কারাদণ্ড।
অফিসিয়াল সিক্রেসট অ্যাক্ট এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানে যদি কেউ যায় বা যেতে উদ্যত হয় বা ওই স্থানের কোনো নকশা বা স্কেচ তৈরি করেন বা কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করেন তবে তিনি অপরাধী হবেন।
৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি গোপনে কোনো সংবাদ পেয়ে থাকলে সেই সংবাদ প্রকাশ করতে পারবে না। কোনো সংবাদপত্র যদি কোনো গোপন সংবাদ প্রকাশ করে তবে প্রতিবেদক, সম্পাদক, মুদ্রাকর এবং প্রকাশক অপরাধী হবেন। এসব কাজে সহায়তা করা অপরাধ বলে গণ্য হবে।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, ৩ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা আছে তিন বছর আর ৫ ধারায় দুই বছর।
চারটি ধারা একসঙ্গে চলছে সর্বোচ্চ সাজাও তিন বছর হবে বলেও মনে করেন তিনি।
তবে ৩ ধারায় যে গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলা হয়েছে, সেটি রোজিনা কীভাবে করেছেন, সেটা বুঝতে পারছেন না জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। বলেন, ‘দেশের ভেতর কোনো সাংবাদিক কীভাবে গুপ্তচরবৃত্তি করলেন, আইডিয়াটাই আমার মাথায় ঢুকছে না।’
রোজিনার বক্তব্য
মঙ্গলবার রাত সোয়া ২টায় রোজিনার সঙ্গে দেখা করেন তার ভাই মো. সেলিম। এ সময় তারা প্রায় আধাঘণ্টা কথা বলেন। পরে থানা থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন সেলিম।
তিনি বলেন, ‘সে (রোজিনা) বারবার বলেছে, আমি এমন কোনো অন্যায় করিনি, এমন কোনো অপরাধ করিনি, আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ অন্যায় করা হয়েছে, অপরাধ করা হয়েছে। আমি মানসিকভাবে বিপর্যন্ত। আমি আমার বন্ধুদের কাছে সাহায্য কামনা করছি।’
সেলিম আরও বলেন, ‘রোজিনা মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছে। … ও (রোজিনা) এ কথাটাই বলেছে, আমি প্রচণ্ড রকম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি।’
মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ও (রোজিনা) প্রচণ্ড সাহসী একজন মেয়ে। কিন্তু সচিবালয়ের মধ্যে ওকে নির্যাতন করা হয়েছে। ওরে শুধু মারা হয় নাই, ওর বুকের ওপরে ওই অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি এক মহিলা আছে পা চাপা দিয়ে ধরছে, গলা চাপ দিয়ে ধরছে।’
তিনি জানান, ‘রোজিনা আমাকে এই কথাটি জিজ্ঞেস করছে যে, আমার সাংবাদিক বন্ধুরা কি আমার পাশে আছে? আমার বড় ভায়েরা কি আমার পাশে আছে? আমি বলছি, সব সাংবাদিক ভাইয়েরা আছে। ও বারবার সাহায্য কামনা করছে। আমার এই দুঃসময়ে আমার ভায়েরা, আমার বন্ধুরা যাতে আমার পাশে থাকে। ও বার বার এই কথাটাই বলছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি ওর ভাই হিসেবে বলতে চাই, আপনারা রোজিনার পাশে ছিলেন, পুরো প্রক্রিয়াটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকবেন।’
মামলা করবে রোজিনার পরিবার
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করবে তার পরিবার।
আজ মঙ্গলবার (১৮ মে) সকালে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণে রোজিনা ইসলামের স্বামী মনিরুল ইসলাম মিঠু সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পিএস এর রুমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন রোজিনা ইসলাম। মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তারা তার ওপর চড়াও হন। তাকে গলা চেপে ধরা হয়েছে হত্যার উদ্দেশে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জাকিয়া পারভীন, অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা বেগম ও পুলিশ কনস্টেবল মিজানুর রহমান তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে এবং নিচে ফেলে গলায় পাড়া দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে।’
মনিরুল ইসলাম মিঠু বলেন, ‘আমরা শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করবো। আইনজীবীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলছি। যদি থানা মামলা না নেয় তাহলে আদালতে মামলা করবো।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ