স্টেট ওয়াচ ডেস্ক রিপোর্ট : গত বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা ও ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন টেকনাফের ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী। তাঁদের মধ্যে বদির চারভাই ও চার স্বজনসহ ২৭ জন কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায় ফিরেছেন।
মাঝখানে কক্সবাজারে সরকারের নির্দেশে মাদক বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য পুলিশ-র্যাবের ক্রসফায়ারে প্রাণ হারিয়েছে অনেকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, আসলে বদি নিয়ন্ত্রিত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা সেই সময় নিজেদের নিরাপদ রাখার জন্য এসব আটক হওয়ার নাটক পরিচালনা করা হয়। বদির নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা অন্য ব্যবসায়ীদের ক্রসফায়ার ও আইনী হয়রানী করে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। উদ্দেশ্য একটিই – সরকারের বিশেষমহল চায় ইয়াবা ব্যবসা যেনো একজনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এজন্যই সেই সময় মাদক বিরোধী ক্র্যাশ কর্মসূচী চালানো হয়েছিল বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকায় প্রভাবশালী অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, মাদক বিরোধী অভিযান চালিয়ে ‘বদি বিরোধী ইয়াবা ব্যবসায়ী’দের শিকড় উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং বদি নিয়ন্ত্রিত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা নিরাপদে থাকার জন্য সেই আর্তসমর্পণের নামে কারাগারে নিরাপদে অবস্থান করেছিল। কক্সবাজারে বর্তমানে ইয়াবা ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন বদি নিয়েছে। তাই বদির পরীক্ষিত ইয়াবা কারবারের সহযোগীদের জামিনের মাধ্যমে মুক্ত করা হচ্ছে।
যারা জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন তারা সবাই মাদক ও অস্ত্র আইনের চার্জশিটভুক্ত আসামি৷ ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেন৷ আত্মসমর্পণের সময় তারা তিন লাখ পিস ইয়াবা এবং ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে৷ এরপর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়৷ তাদের প্রত্যেককে অস্ত্র এবং মাদক আইনের দুইটি মামলায় আসামি করা হয় ৷ ২০ জানুয়ারি দুই মামলায় তাদের সবার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয় আদালতে৷ ১০২ জনের মধ্যে একজন আটক অবস্থায় মারা গেছেন৷
মুক্তি পাওয়া ১৫ জনের মধ্যে আবদুর রহমান বদির চার ভাই আবদুল শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, ফয়সাল ইসলাম ও আবদুল আমিন, বদির মামা মং মং চিং, ভাগনে সাহেদুর রহমান, ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান, চাচাতো ভাই মো. আলমও আছেন।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট থেকে পাঁচজন জামিন পান৷ ৫ অক্টোবর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন পান সাতজন৷ ওই একই আদালত থেকে ৩ নভেম্বর জামিন পান ১৫ জন৷ তাদের সবাইকে এরইমধ্যে মুক্তিও দেয়া হয়েছে৷ জামিনে মুক্ত সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদির চার ভাই হলেন: আব্দুল শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, ফয়সাল ইসলাম ও আব্দুল আমিন৷ সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি দাবি করেন, ‘‘তারা ছাড়া পাওয়ার পর আমি তাদের শপথ করিয়েছি তারা আর ইয়াবা ব্যবসার সাথে যুক্ত হবে না৷ তারা ব্যবসা বাণিজ্য বা রাজনীতি করবে৷ শুধু আমার ভাইয়েরা কেন এই অঞ্চলের বাকি যারা আছে তারাও জামিনে বেরিয়ে আসবে৷’’
কারাসূত্র জানায়, সর্বশেষ আজ (০৯ নভেম্বর) দুপুরে জামিনে মুক্তি পান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ১৫ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন টেকনাফের বিতর্কিত সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির চার ভাই আবদুল শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, ফয়সাল ইসলাম ও আবদুল আমিন। মুক্তি পাওয়া ১৫ জনের মধ্যে বদির মামা মং মং চিং, ভাগনে সাহেদুর রহমান, ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান, চাচাতো ভাই মো. আলমও আছেন।
আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কারাগারে থাকা আসামিদের মধ্যে আজ (সোমবার) ৪৭ জনের পক্ষে আদালতে জামিনের আবেদন করা হয়। জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল জামিন নামঞ্জুর করে ২২ নভেম্বর শুনানির পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।
ডয়েচে ভেলের কাছে বদি দাবি করেন, ‘‘তারা ভালো হওয়ার জন্যই তো আত্মসমর্পণ করেছে৷ ১৮ মাস বিনা বিচারে কারাগারে ছিল৷ আর কত?
ডয়েচে ভেলের এক প্রকাশিত এক রিপোর্টের সূত্রে জানা যায়, টেকনাফ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর দাবি করেন- ‘‘বাকি যারা কারাগারে আছেন তাদের জামিনের তদবিরও চলছে৷ আর বদি নিজে তার ভাইসহ অন্যদের জামিনের জন্য তৎপর ছিলেন৷ যারা কারাগারের বাইরে ছিলেন তারা সবাই আত্মসমর্পণকারীদের সিন্ডিকেটেরই সদস্য৷ ফলে কারাগারে বসেও তারা তাদের ইয়াবা সিন্ডিকেট পরিচালনা করেছেন৷ এখন তারা বাইরে আসায় ইয়াবা ব্যবসা আরো বেড়ে যাবে৷ অভিযানের সময় তাদের ক্রসফয়ার থেকে বাঁচাতেই বদি আত্মমসর্পণ করিয়ে তাদের কারাগারে পাঠান৷ এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় তাদের জামিনে বের করে আনছেন৷’’
ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, জামিন পাওয়া যে কারোর অধিকার৷ আর আদালত জামিন দিলে আমাদের তো কিছু করার নেই৷
ডয়েচে ভেলের কাছে বদি দাবি করেন, ‘‘তারা ভালো হওয়ার জন্যই তো আত্মসমর্পণ করেছে৷ ১৮ মাস বিনা বিচারে কারাগারে ছিল৷ আর কত? বিনা বিচারে কত দিন কারাগারে থাকবে? এখন যদি তারা বের হয়ে আবার ইয়াবা ব্যবসা করে তাদের ক্রসফায়ারে দেয়া হোক৷’’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রথম তালিকায় ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে তার নিজের নাম জড়িত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমি কক্সবাজারের চারবারের শ্রেষ্ঠ করদাতা৷ এই এলাকায় আমিই সবচেয়ে জনপ্রিয়৷ তাই আমার নামে অপপ্রচার করা হয়৷’’ তার দাবি কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গারা৷
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেনকে ডিডব্লিউ এর পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘জামিন পাওয়া যে কারোর অধিকার৷ আর আদালত জামিন দিলে আমাদের তো কিছু করার নেই৷ তাদের তো কোনো শাস্তি হয়নি৷ মামলা যা আছে চলবে৷ তারা আবার মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লে আবার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷’’
এদিকে মাদকবিরোধী এতগুলো অভিযান চালানো হল, এত আটক ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটার পরও কক্সবাজার-টেকনাফ এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। আগে এসব এলাকায় বদি ছাড়াও অনেকগুলো মাদক চোরাকারবারী গ্রুপ ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করলেও বর্তমানে ইয়াবা ব্যবসা এককভাবে বদি নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেট পরিচালনা করছে বলে আমাদের পর্যবেক্ষনে ধরা পড়েছে।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ