উন্নত চিকিৎসা নিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে সরকারও ইতিবাচক এবং নমনীয়। তবুও যেতে এত দেরি হচ্ছে কেন? রাজনীতির ঘোড়ার আড়াই চালে কি আটকে যাচ্ছে খালেদা জিয়ার সুস্থ হয়ে ওঠা! রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা বলছেন, এ মুহূর্তে সরকারের রাজনৈতিকভাবে কোনও কৌশল, সমঝোতা বা শর্তারোপের বিষয়ে ভাববার কথা নয়। তারপরও রাজনীতির সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা থেকে সরকারকে অনেক কিছুই ভাবতে হচ্ছে হয়তো।
সূত্র মতে, গত ২৭ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ১৫ দিনের পর এভারকেয়ার হাসপাতালে চেস্টের সিটি স্ক্যান ও হৃদরোগের কয়েকটি পরীক্ষার পর চিকিৎসকদের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে চিকিৎসকরা তাকে করোনারী কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করে। প্রতিদিনই তাকে কয়েক লিটার অক্সিজেন গ্রহণ করতে হচ্ছে। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার চিকিৎসা দিচ্ছেন।
কেমন আছেন খালেদা জিয়া?
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে তার মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানান, তার শারীরিক অবস্থা আগের মতোই রয়েছে। গতকাল দুপুরের পর তার অক্সিজেন প্রয়োজনীয়তা খুব কম ছিল। এ সময়ের বেশিরভাগটা তিনি অক্সিজেন সাপোর্ট ছাড়া স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিয়েছেন।
তবে সকাল থেকে তিন-চার লিটার অক্সিজেন লেগেছে। তার ডায়াবেটিস ও ব্লাড প্রেশার অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৭ থেকে ওঠানামা করে।
গতকাল তিনি কিছুটা খাওয়া-দাওয়া করতে পেরেছেন, যা ভালো লক্ষণ। এদিকে তার ফুসফুসে যখন পানি জমে তখন তিনি কষ্ট পান। পানিটা বের করার পর তা লাল দেখায়, যা ভয়ের কারণ বলা যাবে না। এরপরও পরীক্ষা করা হয়েছে। সেখানে ক্ষতিকর কোনো জীবাণু পাওয়া যায়নি। তবে সব মিলিয়ে তাকে ঝুঁকিমুক্ত বলা যাচ্ছে না।
ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন বলেও তিনি জানান।
অনুমতির পর হবে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
সরকারের অনুমতি প্রাপ্তির পরই খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন তার চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন। তিনি জানান, বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়েছে। এখন এটি সরকারের বিষয় তারা কবে নাগাদ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেবে। তবে এখনও খালেদা জিয়াকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা খালেদা জিয়াকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আগের মতোই তার চিকিৎসা অব্যাহত রেখেছে মেডিকেল বোর্ড। তার অবস্থা স্থিতিশীল আছে।
সরকারের অনুমতি পেলে বিমানে নে’য়ার মতো শারীরিক অবস্থা বিএনপি চেয়ারপারসনের আছে কিনা সে বিষয়ে অধ্যাপক জাহিদ বলেন, সরকারের অনুমতির পরেই এ বিষয়ে মেডিকেল বোর্ড পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
কেন বিলম্ব হচ্ছে বিদেশ যাওয়ায়?
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নে’য়ার ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতির বাইরেও বিভিন্ন জটিলতা রয়েছে। কিছু আইনগত জটিলতা রয়েছে। আবার খালেদা জিয়ার পাসপোর্টের মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্য এবং সিঙ্গাপুরের ভিসাসহ করোনার কোয়ারেন্টাইনের বিধিবিধানের জটিলতা এবং দীর্ঘ পথ পাড়ি দে’য়ার বিষয়টিও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। সরকারের অনুমতি পেলে বিমানে নে’য়ার মতো শারীরিক অবস্থা বিএনপি চেয়ারপারসনের আছে কিনা প্রশ্ন করা হলে অধ্যাপক জাহিদ বলেন, সরকারের অনুমতির পরেই এ বিষয়ে মেডিকেল বোর্ড পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। দেশবাসীর কাছে খালেদা জিয়ার আশু রোগমুক্তি কামনা ও দোয়াও চেয়েছেন তিনি।
এ ছাড়া চিকিৎসকদের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর যাবেন, নাকি যুক্তরাজ্যে যেতে পারবেন, এসব নানামুখী জটিলতায় তার বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।
যদিও তার চিকিৎসক তাকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন। অবশ্য এসব নানামুখী সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে এবং তারা এমন প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যাতে বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দেওয়ার ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়া যায়।
খালেদা জিয়ার বয়স এখন ৭৬ বছর এবং তিনি কিছুদিন ধরেই শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। ফলে এখনকার শারীরিক অবস্থায় তিনি বিমানে দীর্ঘযাত্রা করতে পারবেন কিনা, সে ব্যাপারে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত দেবেন বলে জানান পরিবারের একজন সদস্য।
তার একজন ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলেছেন, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জটিলতাগুলোর উন্নতি লক্ষণীয়ভাবে ঘটছে না।প্রায় সবক্ষেত্রে আগের মতোই অবস্থা। সে জন্য তার বিমানে দীর্ঘযাত্রা নিয়ে এখনও সংশয় আছে। লন্ডনে যাওয়ার মতো দূরের যাত্রার সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে তারা আবারও সবকিছু পরীক্ষা করে দেখবেন বলে তিনি জানান।
বিএনপি সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার পাসপোর্টসহ অন্যান্য কাজ তারা অনেকটা এগিয়ে নিয়েছেন। আজ হয়তো লন্ডনের ভিসার জন্য আবেদন করা হবে। সে হিসেবে ভিসা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে নেওয়ার অন্যান্য কার্যক্রমও চূড়ান্ত করা হবে। তার সঙ্গে তিন থেকে চারজন সদস্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে যাবেন। তাদের বিষয়েও সবকিছু ঠিক করা হয়েছে। দলীয় কোনো নেতাকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে না যাওয়ার জন্য উৎসাহী করা হচ্ছে। এরপরও দু-একজন নেতা তার সঙ্গে যাবেন বলে জানা গেছে।
সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতেই খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষে তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার বুধবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে দেখা করে বিদেশযাত্রার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। সরকার বিষয়টি ইতিবাচক এবং মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখার কথা বললেও গতকাল রাত পর্যন্ত অনুমতি মেলেনি।
এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে। আবেদনে উল্লেখ করা মানবিক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত দেবে বলে আশা করছে বিএনপি।
‘খালেদা জিয়ার চিকিৎসা হচ্ছে না’
‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা হচ্ছে না। তার শারিরিক অবস্থা খুবই খারাপ। তার চিকিৎসা হলো মুক্তি। মুক্তি দিলে খালেদা জিয়া কোথায় চিকিৎসা করবে সেটা তার স্বাধীনতা। মানসিক শক্তি না থাকলে সুস্থ হওয়া যায় না। আমাদের অতীতের প্রতিহিংসা, ভুল স্মরণ না রেখে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে’, বলে জানান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
শুক্রবার করোনা পরিস্থিতির সংকটকালে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি-২০২১ এর আওতায় ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি এসব বলেন।
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, আটক ছাত্রদের পাশাপাশি খালেদা জিয়াকেও মুক্তি দেওয়া হোক। খালেদা জিয়ার কিছু হয়ে গেলে পরে আক্ষেপ করতে হবে। এর পাশাপাশি বিএনপিকে জনগণের সমস্যা নিয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান তিনি।
দেশে এখন ভয়াবহ অবস্থা বিরাজমান উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশে এখন ভয়াবহ অবস্থা। করোনা পরিস্থিতি খারাপ, মানুষের মুখে খাবার নেই। এর সাথে যোগ হয়েছে সরকারের ভুল নীতি। গণ পরিবহন চলছে না, অথচ প্রাইভেট গাড়ি চলছে। তবে ঈদে বাড়ি যেতে হলে মানুষের করোনা পরীক্ষা করে বাড়ি পাঠানো উচিত।’
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরার পর গত ১০ এপ্রিল থেকে গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’য় থেকে ব্যক্তিগত চিকিৎসক টিমের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন খালেদা জিয়া। ১৪ দিন পর আবার পরীক্ষা করা হলে তখনও তার করোনাভাইরাস পজিটিভ আসে।
এদিকে, দুই মামলায় দণ্ডিত হয়ে তিন বছর আগে কারাগার যেতে হয়েছিলো ৭৬ বছর বয়েসী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু পর পরিবারের আবেদনে সরকার গত বছরের ২৫ মার্চ শর্তসাপেক্ষে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। তখন থেকে তিনি গুলশানে নিজের ভাড়া বাসা ফিরোজায় থেকে ব্যক্তিগত চিকিতসকদের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার সঙ্গে বাইরের কারও যোগাযোগ সীমিত।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১২৪৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ