বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠার এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দলটি আবারও উদ্যম ফিরে পেয়েছে এবং কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনের মধ্যে নতুন করে গতিশীলতা এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি তাদের সম্ভাব্য ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম ১৮০ দিনের পরিকল্পনা তুলে ধরেছে, যা দলটির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান ও ভবিষ্যৎ রূপরেখার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
বিএনপি বলেছে, বিশ্বের অনেক দেশেই নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলে প্রথম ১০০ দিনে কী কী করবে, সে বিষয়ে পরিকল্পনা প্রকাশ করে। বিএনপি বাংলাদেশে সেই সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চায়। দলটি মনে করে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে প্রথম ছয় মাসে সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য একটি অ্যাকশন-ওরিয়েন্টেড রোডম্যাপ প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে, যাতে দেশের বিভিন্ন খাতে করণীয় স্পষ্টভাবে উপস্থাপন থাকবে।
বিএনপির এই পরিকল্পনার মূল ফোকাস রাখা হয়েছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ওপর। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এক আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলেন, এখনই সময় সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার। শুধুমাত্র গতানুগতিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন সম্ভব নয়; বরং উদ্ভাবনী ও অংশগ্রহণমূলক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মানুষকে আস্থার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
ঢাকা শহরে নারীদের জন্য আলাদা বাস পরিষেবা চালু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যার চালক ও সহকারী হবেন নারী কর্মী। এই ব্যবস্থাটি প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, যাতে নারীদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত হয়। ট্রাফিক সমস্যা নিরসনে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প হাতে নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।
শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবমুখী ও দক্ষতাভিত্তিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে পরিকল্পনায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা বাড়ানো হবে, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং কারিগরি শিক্ষার বিস্তারে স্বল্পমেয়াদি ট্রেড কোর্স চালুর কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি, শিক্ষা ও শিল্পখাতের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে এপ্রেন্টিসশিপ ও ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম চালু হবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নতুন উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সিড ফান্ড বা ইনোভেশন গ্র্যান্ট দেওয়া হবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। ধর্ষণ, ছিনতাই, চুরি এবং অন্যান্য অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার অঙ্গীকার রয়েছে। পুলিশের মনোবল বাড়াতে ট্রেনিং, কনসালটেশন ও মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
স্বাস্থ্যখাতে রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হবে। এর আওতায় টিকাদান কর্মসূচি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে আধুনিক পরিশোধন ব্যবস্থা এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য রিজার্ভার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বড় পরিসরে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিএনপি। প্রাথমিক পর্যায়ে ৫০ লাখ দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারকে ‘ফ্যামিলি কার্ড’ দেওয়া হবে, যা পরিবারের নারী সদস্যের নামে ইস্যু করা হবে। এর মাধ্যমে মাসিক আর্থিক সহায়তা বা খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে নারীদের জন্য ডেডিকেটেড সাপোর্ট সেল চালু করা হবে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনার দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থাও করা হবে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে বিএনপি বলেছে, অতীতের শহীদ ও গণতন্ত্রকামীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে। ১৯৭৭ সালের জুলাই অভ্যুত্থান এবং ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে নিহত শহীদদের তালিকা তৈরি করে তাদের নামে সরকারি স্থাপনার নামকরণ করা হবে। শহীদ পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া হবে এবং যেসব গণতন্ত্রকামী ব্যক্তি আহত বা পঙ্গু হয়েছেন, তাদের চাকরির ব্যবস্থা করার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
বিএনপির এই পরিকল্পনা মূলত একটি সুদূরপ্রসারী রূপরেখা, যা দলটি ক্ষমতায় গেলে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চায়। এতে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী নিরাপত্তা ও আইনের শাসনের মতো মৌলিক খাতগুলোতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনার লক্ষণীয় ইঙ্গিত রয়েছে। দলটি মনে করছে, একটি কার্যকর ও জনমুখী সরকার গঠনের জন্য এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
আপনার মতামত জানানঃ