মহাকাশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে চীনের রকেট। চীনের বৃহত্তম রকেটের ১০০ ফুট লম্বা মূল অভ্যন্তরীণ অংশ প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসছে প্রথিবীর দিকে। এই রকেটের এই অংশের ওজন ২১ হাজার কেজি এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে এটি পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় আছড়ে পড়তে পারে। একই সঙ্গে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন যে, পৃথিবীর যে অংশে রকেটের ওই অংশ পতিত হবে, সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। জানা গিয়েছে সেকেন্ডে ৪ মাইল গতি নিয়ে এটি পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে।
কবে আছড়ে পড়তে পারে
বিজ্ঞানীদের ধারণা, রকেটের ধ্বংসাবশেষ আগামী ১০ মে বা তার দুই/একদিন আগে-পরে পৃথিবীতে পড়তে পারে। আছড়ে পড়ার কেবলমাত্র ঘণ্টাখানেক আগে বিজ্ঞানীরা হয়তো সেটি ঠিক কোথায় পড়তে যাচ্ছে সেটি চিহ্নিত করতে পারবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাইক হাওয়ার্ড সিএনএনকে বলেছেন, ধারণা করা হচ্ছে চীনের লং মার্চ ৫বি রকেটটি ৮ মে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারে। তবে মার্কিন স্পেস কমান্ড রকেটটির ট্র্যাক করছে।
ইতোমধ্যে অ্যারোস্পেস ডট অর্গ রকেটটি ট্র্যাক করেছে। এটি ৮ মে রাত সাড়ে ৯টার দিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারে। তবে এর সময় পরিবর্তনও হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহে উৎক্ষেপণ করা চীনা রকেটের ওই অবশিষ্টাংশ কয়েক দিনের মধ্যেই বায়ুমণ্ডল অতিক্রম করে ভূপৃষ্ঠে বা সমুদ্রে আছড়ে পড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
ইউএস স্পেস সার্ভিল্যান্স নেটওয়ার্ক বলছে, রকেটটি রবিবার (৯ মে) মধ্যাহ্নের সময় অথবা এর একদিন বা দু’দিন পর পড়তে পারে। তবে, অন্য সূত্র বলছে, রবিবার সকাল ১১টা থেকে সোমবার (১০ মে) ভোর ৫টার মধ্যে রকেটের ধ্বংসাবশেষ পড়তে পারে। তবে, নতুন ডাটায় এই তথ্য আরো বেশি নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে মনে করছে ইউএস স্পেস সার্ভিল্যান্স নেটওয়ার্ক।
কোথায় পড়তে পারে
চীনা রকেটের ধ্বংসাবশেষ এই সপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীতে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন মার্কিন বিজ্ঞানীরা। তবে ঠিক কখন এবং পৃথিবীর কোন অংশে রকেটটির ধ্বংসাবশেষ আছড়ে পড়বে সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না।
ধ্বংসাবশেষটি জনাকীর্ণ এলাকায় পড়বে না বলে আশা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অস্টিন। তার বক্তব্য, ‘আমরা আশা করছি এটি এমন এক জায়গায় পড়বে, যেখানে মানুষ থাকবে না। কারো ক্ষতি হবে না। মহাসাগর কিংবা এমন কোনো স্থান হতে পারে।’
চীনের স্থানীয় গণমাধ্যম কয়েক সপ্তাহ ধরে বলে আসছে, ধ্বংসাবশেষটি আন্তর্জাতিক জলসীমায় পড়বে।
চীনের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, ক্ষতি কমাতে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
অ্যারোস্পেস নলেজ ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক ওয়াং ইয়ানান বলেছেন, এর বেশিরভাগ অংশই পৃথিবীতে পুনঃপ্রবেশের সময়ই পুড়ে যাবে; খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ ভূমিতে, মানুষের কার্যকলাপ থেকে অনেক দূরে কোনো এলাকায় বা সমুদ্রে পড়তে পারে।
হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের সদস্য ম্যাকডোয়েল বলেছেন, পৃথিবীতে পুনঃপ্রবেশের পর রকেটের ২১ টন ওজনের অংশটি টুকরো টুকরো হয়ে এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে পারে, যেমনটা ছোট বিমান দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়। ১০০ মাইল এলাকাজুড়ে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় এসব টুকরো পাওয়া যেতে পারে।
কক্ষপথে এখনকার অবস্থান অনুযায়ী রকেটটির ধ্বংসাবশেষ উত্তরের নিউ ইয়র্ক থেকে শুরু করে মাদ্রিদ, বেইজিং এমনকী দক্ষিণের চিলি বা নিউ জিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে বা এর মাঝামাঝি যে কোনো জায়গায় পড়তে পারে, ধারণা ম্যাকডোয়েলের।
বিবিসি সাইন্স এর জোনাথন আমোস বলেন, ‘‘রকেটের ধ্বংসাবশেষটি স্থলভাগের উপর ধসে পড়ার আশঙ্কা খুবই কম। কারণ, পৃথিবীর ৭০ ভাগ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে পানি। আর এমন জ্বলন্ত কিছু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়ার পর সেটির পানিতে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।”
বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা রকেটের ধ্বংসাবশেষের গতিবিধির উপর নজর রাখছে। তবে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে সেটিকে ভূপাতিত করার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।
যু্ক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন বলেন, ‘‘আমরা আশা করছি এটি এমন কোনো জায়গায় পড়বে যেখানে কারো কোনো ক্ষতি হবে না। এটি সমুদ্র বা পানিতে পড়বে বলেই আমাদের আশা।”
চীনা রকেটের ধ্বংসাবশেষ কি বাংলাদেশে পড়বে?
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো)-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাহমুদুর রহমান বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতায় আমরা আসলে রকেটটিকে ট্রেস করতে সক্ষম নই। তবে, যে অরবিটে চীনের ফাইভ বি রকেটের ধ্বংসাবশেষ অবস্থান করছে সে অনুযায়ী বাংলাদেশে আপাতত পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে, যেকোনো সময় অরবিট পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
স্পারসো-এর অপর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. নূর হোছাইন শরীফি বলেন, স্যাটেলাইট ট্রেসিং প্রযুক্তি না থাকায় আসলে এই বিষয়ে সঠিক কোন তথ্য এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। আর্ন্তুজাতিক বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ফাইভ বি রকেটটির ধ্বংসাবশেষ পৃথিবীর লোয়ার আর্থ অরবিটে যখন আসবে তখন বলা সম্ভব মূলত কোথায় পড়তে পারে।
রকেটটির বর্তমান অবস্থান
মহাকাশে এই রকেটের ধবংসাবশেষ এখন পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে এবং এটি বায়ুমণ্ডলের নিম্ন স্তরে ঢুকছে। যার মানে হল, এটি পৃথিবীর চারিদিকে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে নীচের দিকে নেমে আসছে।
বিবিসি সাইন্স এর জোনাথন আমোস বলেন, ধ্বংসাবশেষটি বিষুবরেখা উত্তর ও দক্ষিণে ৪১ ডিগ্রি এলাকার মধ্যে আছে। এটি উত্তরে নিউইয়র্ক, ইস্তাম্বুল ও বেইজিং এবং দক্ষিণে নিউ জিল্যান্ডের ওয়লিংটন ও চিলির উপর দিয়ে ঘুরছে।
আর্থ অবজারভেটরি সিঙ্গাপুরের জেসন স্কট হেরিন বিবিসিকে বলেছেন,”মধ্যাকর্ষণ টানের ফলে এই ধ্বংসাবশেষ নীচের দিকে আরও ঘণ বায়ুমণ্ডলের দিকে নামতে থাকবে, এর ফলে মধ্যাকর্ষণ টান এবং নীচের দিকে নেমে আসার গতিবেগ আরও বাড়তে থাকবে।”
“একবার এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে, বস্তুটি একটি একটি নির্দিষ্ট দিকে নীচের দিকে ধেয়ে আসতে থাকবে,” তিনি উল্লেখ করেন।ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ুমণ্ডল ক্রমেই ঘন হতে থাকায় রকেটের ধ্বংসাবশেষের বেশিরভাগ আগুনে পুড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যে অংশগুলো পুড়বে না সেগুলোই পৃথিবীতে ভেঙে পড়বে।যদি এই সমস্ত কিছু অনিয়ন্ত্রিতভাবে হয়ে থাকে তাহলে কোথায় রকেটের ধ্বংসাবশেষ পুড়বে এবং কোথায় এসে পড়বে সেটাও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বা সঠিক পূর্বাভাসও দেওয়া যাবে না।
মার্কিন মহাকাশ কমান্ড জানিয়েছে, লস এঞ্জেলেসের ২৫৭ কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমে ভ্যানডেনবার্গ বিমান ঘাঁটিতে অবস্থিত তাদের ১৮ মহাকাশ নিয়ন্ত্রণ স্কোয়াড্রন অনিয়ন্ত্রিত চীনা রকেটটির গতিপথে নজর রাখছে; কোন পথে এটি পৃথিবীতে প্রবেশ করবে, তা জানতে নিয়মিত আপডেট নিচ্ছে।
এই স্কোয়াড্রনটি মহাকাশে থাকা ২৭ হাজারের বেশি মনুষ্যনির্মিত বস্তুর গতিপথে নজর রাখে, যার বেশিরভাগই কক্ষপথের নিচের অংশে পৃথিবীর কাছাকাছি আছে বলে জানিয়েছে মহাকাশ কমান্ড।
‘লং মার্চ ৫বি রকেট’
চীনের বানানো এই বৃহত্তম রকেটটির নাম- ‘লং মার্চ ৫বি রকেট’। মহাকাশে খুব গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের জন্যই এই শক্তিশালী রকেট বানিয়েছে চীনা মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। পৃথিবীর কক্ষপথে নিজের দেশের একটি মহাকাশ স্টেশন বানাতে চলেছে চীন। প্রকল্পের নাম- ‘তিয়ানহে মহাকাশ স্টেশন’। তা উৎক্ষেপণের জন্য কিছু দিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে চিন। ওই মহাকাশ স্টেশনের একটি ‘মডিউল’ অংশ পরীক্ষামূলক ভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠাতে গত ২৯ এপ্রিল লং মার্চ ৫বি রকেট-এর উৎক্ষেপণ করেছিল চিনা মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
স্পেসনিউজ জানায়, চীনা রকেটটি সফলভাবে মহাকাশ স্টেশনের ‘মডিউল’টিকে কক্ষপথে স্থাপন করতে পারলেও নিজেকে আর গ্রাউন্ড স্টেশনের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। ঘুরে চলেছে পৃথিবীর কক্ষপথে। তার ভিতরের ১০০ ফুট লম্বা (৩০ মিটার) অংশটি রকেট থেকে আলাদা হয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে দিন কয়েকের মধ্যেই ঢুকে পড়তে চলেছে। রাডারে তা ধরাও পড়েছে। অংশটি এখন ভূপৃষ্ঠের ১০৬ মাইল থেকে ২৩১ মাইল উচ্চতার মধ্যে ওঠা-নামা করছে। তার উপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই চীনা মহাকাশ গবেষণা সংস্থার গ্রাউন্ড স্টেশনের। ফলে বায়ুমণ্ডলে ঢোকার পর যেকোনো সময় পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে তা ভেঙে পড়তে পারে।
১৯৯০ সালে বিজ্ঞনীরা ইচ্ছাকৃতভাবে ১০ টন ওজনের একটি রকেট পৃথিবীর কক্ষপথে ছেড়ে দিয়েছিলেন। যেটি পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে। ২০১৮ সালে চীনের টিয়াংগং-১ নামে এই মহাকাশ গবেষণা স্টেশনটির ধ্বংসাবশেষ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে আছড়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, দ্য লং মার্চ-৫বি যান আকারে এর থেকেও বড়।
লং মার্চ ৫বি এর ধ্বংসাবশেষের ওজন ২১ টন। এটি এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে ধসে পড়তে যাওয়া সবচেয়ে বেশি ওজনের ধ্বংসাবশেষ হতে যাচ্ছে। ধ্বংসাবশেষটি ৯৮ ফুট লম্বা এবং ১৬ ফুট চওড়া। সেটি বর্তমানে কক্ষপথ হয়ে পৃথিবীর দিকে ঘণ্টায় প্রায় ২৭ হাজার ৬০০ কিলোমিটার গতিতে ধেয়ে আসছে।
চীন মহাকাশে নিজের আধিপত্য কায়েম করতে যে আচরণ করছে তা বিশ্বের সুরক্ষার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে উঠছে। চীন ইতিমধ্যে বিশ্বকে করোনা ভাইরাস উপহার দিয়েছে ,যার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে বিশ্বের অর্থব্যবস্থা। এখন চীনের রকেট বিশ্বের জন্য একটি নতুন সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ