বিশেষ প্রতিবেদক : ভারতে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিনই চলছে সংক্রমণের রেকর্ড ভাঙাগড়ার খেলা। গত সপ্তাহে বিশ্বে প্রথমবারের মতো একদিনে তিন লাখ রোগী শনাক্তের রেকর্ড গড়েছিল দেশটি। শনিবার সেই রেকর্ড ভেঙে চার লাখ রোগী শনাক্তের রেকর্ডও নিজেদের করে নিয়েছে দেশটি। সরকারের গাফিলতি, দায়িত্বহীনতা, করোনার মধ্যে বিধানসভা নির্বাচন আর কুম্ভমেলা করোনা সংক্রমণের এই উর্ধ্বগতির কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, ভারতে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন শনাক্তের জন্য বৈজ্ঞানিক পরামর্শকদের নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে ‘ইন্ডিয়ান সার্স-কভ-২ জেনেটিকস কনসোর্টিয়াম’ (আইএনএসএসিওজি) গঠন করে ভারতীয় সরকার। বিজ্ঞানীদের এই ফোরাম তাদের কাজের সুবিধার্থে ভারতের বড় ১০টি ল্যাবরেটরিকে একসুতোয় বেঁধেছিল। তবে এই সংস্থার দে’য়া সতর্কবার্তাও কানে তোলেনি মোদি সরকার। যার পরিণতিতে ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়েছে দেশটি।
মোদি সরকারের গাফিলতি
গত মার্চ মাসের প্রথমদিকে করোনাভাইরাসের নতুন ও অধিক সংক্রামক একটি ধরন মাত্র ছড়াতে শুরু করেছিল ভারতে। তখনই মোদি সরকারকে এ বিষয়ে সতর্ক করে বিশেষজ্ঞদের ফোরাম আইএনএসএসিওজি।
সরকারের নির্দেশে এই ফোরাম গঠিত হলেও তাদের পরামর্শ কানে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। নেয়নি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা। সরকারের এমন গাফিলতিই কাল হয়েছে দেশটির জন্য।
আইএনএসএসিওজি জানায় তাদের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বাড়তি কোনও কড়াকড়ি আরোপ করেনি। ঝুঁকির মধ্যেই লাখ লাখ মানুষকে কুম্ভমেলায় জড়ো হওয়ার অনুমতি দিয়েছে। নির্বাচনী জনসভা করে বেড়িয়েছেন খোদ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার দলের নেতাকর্মীরা। এছাড়া মোদি সরকারের কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লির কিনারে ঘাঁটি গেড়ে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে হাজার হাজার কৃষক।
এ অবস্থায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশটি আজ করোনার সুনামিতে ডুবতে বসেছে। মহামারির প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে কয়েকগুণ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় ঢেউ। এর পেছনে ভারতে শনাক্ত করোনার নতুন ধরন ও ভাইরাসটির ব্রিটিশ ধরনের বড় অবদান রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্য গোপন করেছে মোদি সরকার
সংক্রমণের ভয়াবহতার বিষয়ে মোদি সরকারকে মার্চের শুরুতেই সতর্ক করেছিল আইএনএসএসিওজি। সূত্র মতে, এই ফোরাম এমন একজন শীর্ষ কর্মকর্তার অধীনে, যিনি সরাসরি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করেন।
নাম না প্রকাশের শর্তে আইএনএসএসিওজির এক গবেষক বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। তবে বিজ্ঞানীদের সেই সতর্কবার্তা নরেন্দ্র মোদির কাছে পৌঁছানো হয়েছিল কি না তা নিশ্চিত হতে পারেনি বার্তা সংস্থাটি।
আইএনএসএসিওজি ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকেই বি.১.৬১৭ চিহ্নিত করেন, যেটি করোনার ভারতীয় ধরন বলে পরিচিত। আইএনএসএসিওজি তাদের আবিষ্কারের তথ্য ১০ মার্চের আগেই ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (এনসিডিসি) কাছে পাঠিয়ে দেয়।
নর্দার্ন ইন্ডিয়া রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক বলেন, তাদের গবেষণালব্ধ তথ্য এরপর সরাসরি ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য তৈরি একটি খসড়ায় বলা হয়েছিল, করোভাইরাসের ভারতীয় ধরনে দুটি উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটেছে এবং এটি ভারতের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্য মহারাষ্ট্রের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ নমুনায় ধরা পড়েছে।
খসড়া বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, ই৪৮৪কিউ ও এল৪৫২আর নামে রূপান্তর দুটি ‘মারাত্মক উদ্বেগ’-এর কারণ। করোনার ভারতীয় ধরনটি সহজেই মানবকোষ আক্রমণ করে ওই ব্যক্তির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে।
ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব তথ্য প্রকাশ্যে আনে আরও দুই সপ্তাহ পর, মার্চের ২৪ তারিখে। তবে তারা যে বিবৃতি দিয়েছিল, সেখানে ‘মারাত্মক উদ্বেগ’ কথাটির কোনও উল্লেখ ছিল না।
তারা শুধু বলেছিল, অধিক সংক্রামক নতুন ধরনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্যে নমুনা শনাক্তকরণ ও কোয়ারেন্টাইন বাড়ানো হচ্ছে।
তবে নর্দার্ন ইন্ডিয়া রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক জানিয়েছেন, তাদের তৈরি খসড়া বিবৃতি ভারতের শীর্ষ আমলা মন্ত্রিপরিষদ সচিব রাজিব গৌবার কাছে পাঠানো হয়েছিল, যিনি সরাসরি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করেন।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি দেয়ার পরেও লোকসমাগম কমাতে কোনও পদক্ষেপই নেয়নি ভারত সরকার। ফলে মাত্র একমাসের ব্যবধানে সংক্রমণের হার চারগুণ বেড়ে যায়।
করোনার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারতের সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ। এর মধ্যেই সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন।
পশ্চিমবঙ্গে এপ্রিল মাসের প্রথম দিন করোনা শনাক্তের হার ছিল প্রায় ৫ শতাংশ। মাসের শেষে সেই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশে। এ রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন শুরুর পর থেকেই করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। এখন পরিস্থিতি এমন যে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মিলছে না শয্যা। অভাব দেখা দিয়েছে অক্সিজেনের।
করোনার এই সংক্রমণ নিয়ে একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২৭ মার্চ প্রথম দফার নির্বাচনের দিন এই রাজ্যে সংক্রমণের হার ছিল ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২।
দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ১ এপ্রিল সেই সংক্রমণ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশে। মৃত মানুষের সংখ্যা ছিল ২ জনই।
পঞ্চম দফায় ১৭ এপ্রিল সংক্রমণের হার দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৪২ শতাংশ আর মৃত মানুষে সংখ্যা একবারে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪।
ষষ্ঠ দফার নির্বাচনের দিন ২২ এপ্রিল সেই সংক্রমণের হার বেড়ে দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। মৃত মানুষের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬।
আর সপ্তম দফার ভোটের দিন সেই সংক্রমণ হার আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর মৃত মানুষের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮।
কুম্ভমেলায় চিন্তাতীত মানুষের ঢল
বিশ্বের অন্যতম বড় জনসমাগম হিসেবে পরিচিত কুম্ভমেলা। এই বছর ভারতে করোনা ভাইরাসের মহামারির মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অন্যতম পবিত্র এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পাপ মুক্তির আশায় গঙ্গা নদীতে গোসল করেন তীর্থযাত্রীরা।
এদিকে হরিদ্বার শহরে কুম্ভমেলা উৎসবে অংশ নে’য়া হাজার হাজার পূণ্যার্থী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে শীর্ষ নয় পূজারিও রয়েছেন।
ভারতের হরিদ্বারে আয়োজিত কুম্ভমেলায় পাঁচ দিনে ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হয়। হরিদ্বারের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শম্ভু কুমার ঝাঁ ১২ এপ্রিল গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান।
১২ ও ১৪ এপ্রিল কুম্ভমেলায় অনুষ্ঠিত গঙ্গাস্নানে ৪৮ লাখ ৫১ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে এনডিটিভির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এ সময় করোনা ঠেকানোর স্বাস্থ্যবিধি সেভাবে মানা হয়নি।
মোদির পদত্যাগের দাবি
ভারতে করোনা সঙ্কট যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে বিপর্যয় নেমে এসেছে সেজন্য কেন্দ্রীয় সরকারকেই দায়ী করছেন সাধারণ নাগরিকদের একটি বড় অংশ।
ব্যর্থতার দায় নিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে বলে দাবি তুলে নেটমাধ্যমে হ্যাশট্যাগ ‘রিজাইনমোদি’ লিখে পোস্ট করেছেন হাজার হাজার মানুষ। গত বুধবার সকাল থেকে টুইটার এবং ফেসবুকে অন্যতম জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগ হিসেবে উঠে এসেছিল সেটি। বৃহস্পতিবার সকালেও টুইটারের হ্যাশট্যাগের তালিকায় শীর্ষে ছিল হ্যাশট্যাগ ‘রিজাইনমোদি’।
এ প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘ভারতে করোনার প্রকোপ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র সরকার করোনার চলমান এই প্রকোপ ঠেকাতে ব্যর্থ। মহামারি মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতেও মোদি ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তার এখনই পদত্যাগ করা উচিত।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিডের বিরুদ্ধে কার্যত শূন্য থেকে লড়াই শুরু করলেও নরেন্দ্র মোদি সরকারের হাতে এক বছরের বেশি সময় ছিল। কিন্তু ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বা গোষ্ঠী সংক্রমণের ওপরে সরকারের ভরসা এবং অতিরিক্ত প্রতিষেধক নির্ভরতার কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে গেছে। গত নভেম্বর থেকে যখন সংক্রমণের হার কমতে শুরু করেছিল, তখন জনতা যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছেড়ে দেয়, তেমনই গা-ছাড়া মনোভাব দেখা যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও। এর সঙ্গে রয়েছে টিকা নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতির অভাব। অনেকেই মনে করছেন, যথেষ্ট প্রতিষেধক না থাকা সত্ত্বেও বিদেশে প্রচুর টিকা রফতানির ফলে দেশটিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। উপরন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দুটি মাত্র সংস্থার ভরসায় ভারতের মতো দেশে টিকাকরণ শুরুর পরিকল্পনা যথেষ্ট ঝুঁকির ছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০৫৬
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ