হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরীফ উল্লাহকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ীর মীর হাজিরবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পৃথক অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর কমিটির সহসভাপতি ইলিয়াস হামিদীকে। এছাড়া গ্রেপ্তার করা হয়েছে মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী ও বশির উল্লাসহ আরও অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেশে আসা নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করে হেফাজতে ইসলাম। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন নিহত হন। এরপর থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
মুফতি শরিফুল্লাহ গ্রেপ্তার
ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফুল্লাহকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তিনি ধর্মভিত্তিক সংগঠনটির ঢাকা মহানগরের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকেরও দায়িত্ব রয়েছেন।
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় সরকারী-বেসরকারি স্থাপনা, যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়ের মামলার এজাহারভুক্ত আসামি শরিফুল্লাহ। ওই মামলা দায়েরের প্রায় ৮ বছর পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করল।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলে আসছেন, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে নাশকতায় হাজার হাজার লোক অংশ নেয়। এতে আসামি শনাক্ত করতে সময় লাগছে। ঘটনার পর আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও বেশির ভাগ আসামিও পলাতক ছিল। এখন তাদের অবস্থান শনাক্তের পর গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী বিভাগের ডিসি আব্দুল আহাদ গণমাধ্যমকে বলেন, তাদের একটি দল গোপন খবরের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে যাত্রাবাড়ীর মীর হাজিরবাগ এলাকায় অভিযান চালায়।
ওই অভিযানে অংশ নেওয়া ডিবির ডেমরা জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. আজাহারুল ইসলাম মুকুল বলেন, শরিফুল্লাহর বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় একটিই মামলা পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালের ৫ মে তাণ্ডবে তিনি অন্য কোনো থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি কি-না তা যাচাই করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ মে’র ভয়াবহ তাণ্ডব ও সহিংস ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৭টি হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৪২টি মামলা হয়। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানায় ৩ টি মামলা হয়েছিল।
এদিকে গ্রেপ্তার হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফউল্লাহকে সাত দিনের রিমান্ডে চায় পুলিশ। এই আবেদন করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
বুধবার (১৪ এপ্রিল) তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এ সময় পুলিশকে হত্যার উদ্দেশে করা বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় সুষ্ঠুতদন্তের তদন্তের জন্য তাকে সাতদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক আয়ান মাহমুদ।শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম আবু সাঈদ তার একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মুফতি ইলিয়াস হামিদী গ্রেপ্তার
ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলায় একটি মাদ্রাসা থেকে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহ-অর্থ সম্পাদক মুফতি ইলিয়াস হামিদীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাব-২ অপস্ অফিসার এএসপি আবদুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যমকে বলেন, নাশকতার পরিকল্পনা, ধর্মীয় উগ্রবাদিতা ছড়ানো, ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে সোমবার রাতে কেরাণীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এঘটনায় র্যাব- ২ ওয়ারেন্ট অফিসার জামাল উদ্দিন বাদি হয়ে মুফতি ইলিয়াসসহ মোট ৯ জনের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করেছেন।
মামলার বরাত দিয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী রমজানুল হক বলেন, “হেফাজত নেতা মামুনুল হক পরিচালিত ‘তারবিয়াতুল উম্মাহ মাদ্রসা’য় কয়েকজন বসে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে এমন খবর পেয়ে র্যাবের একটি দল সেখানে অভিযান চালায়।
“অভিযানের খবর পেয়ে অন্যরা পালিয়ে গেলেও মুফতি ইলিয়াস হামিদীকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। তার সাথে পলাতক ৮ জন ছাড়াও জামাত শিবিরসহ সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেকে উপস্থি ছিল বলে গ্রেপ্তারের পর মুফতি ইলিয়াস জানায়।”
নাশকতার পরিকল্পনা, ধর্মীয় উগ্রবাদিতা ছড়ানো, ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে সোমবার রাতে কেরাণীগঞ্জের ঘাটারচর ‘তারবিয়াতুল উম্মাহ মাদ্রসা’ থেকে ইলিয়াস হামিদীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এদিকে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর কমিটির সহসভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদীকে জিজ্ঞাসাবাদে সাত দিনের হেফাজত পেয়েছে কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ।
মঙ্গলবার ঢাকার কেরানীগঞ্জের মডেল থানার একটি সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবেদন করলে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক রাজীব হাসান মঙ্গলবার তার রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানা পুলিশ সাত দিনের রিমান্ড চেয়েছিল বলে জানিয়েছেন আদালত পরিদর্শক মেজবাহ উদ্দিন।
তিনি বলেন, হেফাজত নেতার পক্ষে রিমান্ড বাতিল চেয়ে আবেদন করা হলে শুনানি শেষে তা নাকচ করেন বিচারক।
মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী গ্রেপ্তার
এর আগে রোববার চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) যৌথ অভিযানে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।ওই নেতাও ২০১৩ সালের নাশকতার চারটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম-কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের জ্বালাও-পোড়াওয়ের অভিযোগে আজিজুল হক ইসলামাবাদীর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়। ওই মামলায় গতকাল (রোববার) ডিবি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।’
গ্রেপ্তারের আগে ইসলামাবাদী নিখোঁজ হয়েছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়।পরে সোমবার (১২ এপ্রিল) দুপুরে ইসলামাবাদীর ছোট ভাই ফয়েজুল হক তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে লেখেন, ‘বড়ভাই হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তিনি ঢাকা ডিবি অফিসে আছেন, সুস্থ আছেন। উদ্বিগ্ন না হয়ে সবাই ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন।’
হাটহাজারী মাদরাসার বৈঠক শেষ করে যাওয়ার পর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। তবে নিখোঁজের পর থেকে হেফাজতের একাধিক নেতা দাবি করেছিলেন, তিনি হাটহাজারী থানায় আটক আছেন।
বশির উল্লাহ গ্রেপ্তার
হেফাজতে ইসলামের হরতালে নাশকতা ও সহিংসতার অভিযোগে করা মামলায় সংগঠনটির নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক বশির উল্লাহকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মঙ্গলবার রাত ১১টায় সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় লন্ডন মার্কেট এলাকার নির্মাণাধীন একটি বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মশিউর রহমান জানান, হেফাজত নেতা বশির উল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি ২৮ মার্চ হেফাজতে ইসলামের হরতালের নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম ছিলেন।
বশির উল্লাহ মামলার এজহারভুক্ত আসামি নন বলে জানান ওসি।
হেফাজতের ডাকা ২৮ মার্চের হরতালে নাশকতা ও সহিংসতার ঘটনায় এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে সিটি কাউন্সিলর ইকবাল হোসেনসহ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের প্রতিক্রিয়া
গত ২৮ মার্চ হেফাজতে ইসলামের হরতালে সংঘর্ষে পুলিশ ও সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয় দুই জন। দুটি গণমাধ্যমের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্সসহ শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর ও ১৮টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
ওই ঘটনায় পুলিশ ও র্যাব বাদী হয়ে ৬টি মামলা করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারত সফরের সময় গত ২৬শে মার্চ থেকে তিন দিন ধরে হেফাজতের কর্মসূচিকে ঘিরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী এবং ঢাকার বায়তুল মোকাররম এলাকায় ব্যাপক সহিংসতা এবং কমপক্ষে ১৭ জনের প্রাণহানি হয়।
হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই ৫১টি মামলা করা হয়েছে শত শত অজ্ঞাতনামাকে অভিযুক্ত করে। সেখানে রেলস্টেশন, ভূমি অফিস এবং পুলিশের থানাসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে আক্রমণ, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার নানা অভিযোগ রয়েছে মামলাগুলোতে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ এসব মামলায় জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৬০ এর অধিক আটক করার কথা জানিয়েছে।
এর আগে গত কয়েকদিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একশো জনের বেশি আটক করা হয়েছে।
হেফাজত নেতারা অভিযোগ করেছেন, তিন দিন ধরে হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের প্রায় দু’শ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হেফাজতের কর্মসূচিতে সরকারি বিভিন্ন অফিসে অগ্নিসংযোগ সহ সহিংসতার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
হেফাজত ইসলামের একজন কেন্দ্রীয় নেতা সিরাজুদ্দিন আহমাদ অভিযোগ করেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে। এখন সরকার সারাদেশে বিভিন্ন মামলা দিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের হয়রানি করতেছে এবং ইতিমধ্যে প্রায় দুইশো’র মতো গ্রেপ্তার করে ফেলেছে।”
সংগঠনটির কেন্দ্রীয় মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী বলেছেন, এখন বিভিন্ন মামলা সামনে এনে হেফাজতের নেতাকর্মীদের টার্গেট করে হয়রানি করা হচ্ছে। যে সব মামলা করা হইছে, এগুলোরে ভিত্তি নাই বলে আমরা মনে করি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ