রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা মামলাটি ২০ বছরেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। নিম্ন আদালতে রায় হলেও হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শুরুই হয়নি। কবে নাগাদ শুনানি শুরু হবে, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। এদিকে সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে একই ঘটনায় করা বিস্ফোরক আইনের অপর মামলাটিও।
২০০১ সালের ১৪ই এপ্রিল, বাংলা ১৪০৮ সনের ১লা বৈশাখ রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে জঙ্গিদের বোমা হামলায় নিহত হন ১০ জন৷ আর আহত হয় ২০ জন৷ বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে শুরু হয় শোকের মাতম৷ সকালের কান্নায় বেদনার্ত হয়ে ওঠে পুরো দেশ৷ কিন্তু সময়ে সব কিছু যেন ফিকে হয়ে আসে৷ অনেকেই ভুলে যায় নৃশংসতার কথা, ভয়াবহতার কথা৷ ভুলে যায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের৷ আর যারা পঙ্গু অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাদের খোঁজই বা কে রাখে৷ আর এ কারণেই ২০ বছরেও সেই বোমা হামলার ঘটনার বিচার শেষ হয়নি৷ কবে শেষ হবে তাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না৷
ঘটনার দিন হত্যা ও বিস্ফোরণ আইনে রমনা থানায় ২টি মামলা করে পুলিশ। সাত বছর আগে হামলার ঘটনায় হত্যা মামলার রায়ে আটজনের মৃত্যুদণ্ড ও ছয় জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। রায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৬ জনকে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ দেন আদালত। মামলায় সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ৪ আসামি এখনও পলাতক। তবে একই ঘটনায় করা বিস্ফোরক আইনের মামলায় সাক্ষী না আসায় এখনো শেষ হয়নি বিচার।
মামলা সূত্র্রে জানা গেছে, মামলাতে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর ছলিম উল্যাসহ দুজন সাক্ষ্য দেন। এরপর আর কোনো সাক্ষ্য হয়নি। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে মামলার কিছুটা গতি ফিরেছিল। এরপর প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলার বিচারকাজ এগোয়নি।
মামলাটি ঢাকার ১ নং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌশলী আবু আব্দুল্লাহ ভুইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮৪ জনের মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৫৫ জন। গত ৫ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। করোনা প্রার্দুভাবের কারণে আদালত বন্ধ থাকায় মামলাটির সাক্ষ্য হয়নি। তিনি সাক্ষ্য দিলেই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের কার্যক্রম সমাপ্ত করা হবে। আশা করছি আদালত চালু হলে সাক্ষ্য গ্রহণের কার্যক্রম শেষ করা হবে। সাক্ষ্য শেষ আত্মপক্ষ সমর্থন এরপর যুক্তি উপস্থাপন তার পর মামলাটির রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করা হবে।’
আসামি পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। করোনার কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল চালু হলেই মামলাটি বিচারিক কার্যক্রম শেষ হবে আশা করছি।’
জানা গেছে, ২০১৪ সালের বিচারিক আদালতের রায় ঘোষণার পর হত্যা মামলাটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে আসে। একই সঙ্গে আসামিদের পক্ষ থেকেও জেল আপিল হয়। পরে পেপারবুক প্রস্তুত করে মামলাটি হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চে শুনারি অপেক্ষায় ছিল। ওই বেঞ্চের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ায় বর্তমান অন্য একটি বেঞ্চে কার্যতালিকায় আসে।
বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন মামলার অন্যতম আসামি মুফতি হান্নানসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। মামলাটিতে ৮৪ সাক্ষীর মধ্যে পর্যন্ত মোট ৫৫ সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে ২০১৪ সালের ২৩ জুন হত্যা মামলাটির রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমিন। রায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ৮ জনের মৃত্যুদন্ড ও ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়।
বিস্ফোরক দ্রব্য মামলা চলমান থাকায় মুফতি হান্নানসহ তিনজনের ফাঁসি কার্যকর করা হলেও এখনো আনেকেই ফাঁসির রায় কার্যকর হয়নি। এছাড়া হত্যা মামলায় ৮ আসামির মৃত্যুদন্ড অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) এবং আপিলের শুনানি হাইকোর্টে থমকে থাকায় জন্য বিচার প্রার্থীদের অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। হত্যা মামলায় রায়ের পর ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি মামলাটি আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য হাইকোর্টে উঠে। এছাড়া বিস্ফোরক আইনের মামলায় ২০০৯ সালে অভিযোগ গঠনের পর প্রথম ৭ জনের সাক্ষ্য নেয়া হলেও এরপর বিচার কার্যক্রম গতি হারায় সাক্ষী না আসায়। ২০১৫ সালের ২২ মার্চ থেকে সাক্ষীদের প্রতি সমনের পাশাপাশি গ্রেপ্তারি পরোয়না জারি করা হচ্ছে। গত দুই বছরে মাত্র ২ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে এ মামলায়।
কেন এই হামলা
বিচারিক আদালত ১৪ আসামিকে দণ্ড দিয়ে রায়ে বলেছিলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আতঙ্ক সৃষ্টি করাসহ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে কলুষিত তথা সংস্কৃতির চর্চা বন্ধ করার জন্য বোমা হামলা করেছিলেন আসামিরা।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছিলেন, বাঙালি জাতির ঐতিহ্য পয়লা বৈশাখ বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ২০০১ সালে বোমা হামলায় নিহত ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষ। এই অনুষ্ঠান কোনো নির্দিষ্ট দল-মত-গোষ্ঠী বা ধর্মের লোকজন ছিলেন না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ ওই অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছিল। ওই দিন ভোরে ঘটনাস্থলে দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল এবং পরে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় বলে বিশেষজ্ঞ মতামত পাওয়া যায়। বোমা হামলাকারীদের লক্ষ্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ছিল না। আয়োজক সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
১৮ বছরেও রমনা বটমূলে হামলা মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে প্রথমে কিছুদিন হইচই হয়, আলোচনা হয়, এরপর তা হারিয়ে যায়। বিচারিক আদালতে কয়েকজনের শাস্তি হয়েছে, এটুকু যা সান্ত্বনা। রাজনৈতিক পরিচয়ে সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগ হয়ে থাকে। ভুক্তভোগীরা ভুগতেই থাকেন।
তারা বলেন, কেবল রমনার বটমূলের ঘটনা নয়, অতীতের সব বোমা ও গ্রেনেড হামলার বিচার করতে হবে৷ বিচারহীনতার সংস্কৃিত অপরাধীদের বেপরোয়া করে তোলে৷ যে অন্ধকারের রাজনীতি জঙ্গিদের এ ধরনের বোমা ও গ্রেনেড হামলা করতে প্ররোচিত করে, সেই রাজনীতিরও অবসান ঘটাতে হবে৷ এই অপশক্তিকে শিকড়সমেত উপড়ে ফেলতে না পারলে ফের তারা যেকোনো সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে৷ তাই বিষয়টি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে এর বিরুদ্ধে সব গণতান্ত্রিক শক্তি ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে একত্র করতে হবে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ