দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারত-চীন দ্বৈরথের এক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে। সেই রাজনীতি প্রভাব ফেলেছে ভ্যাকসিন রাজনীতিতেও। ভারত সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার রপ্তানি সাময়িকভাবে স্থগিত করার পর সময়মত টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের টিকা মজুদ কমে যাওয়ায় ভারতের এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভারত থেকে চুক্তির টিকা দ্রুত আনানোর ব্যবস্থা করতে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে চিঠিও দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতেও কাজ হয়নি কোনো। তবে টিকা সরবরাহে ভারতের এই পিছিয়ে পড়ার সুযোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছে যেন চীন। চীন তাদের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের পাঁচ লাখ ডোজ করোনা টিকা বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে পাঠাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত সব চীনা নাগরিককে টিকা দিতে সিনোফার্মকে অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, ‘সিনোফার্ম আমাদের টিকা সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এছাড়াও, তারা উপহার হিসেবে পাঁচ লাখ ডোজ টিকা পাঠাবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অক্সফোর্ডের টিকার অনুমোদন দিলেও এখান পর্যন্ত সিনোফার্ম জাতিসংঘের এই সংস্থাটি থেকে তাদের ভ্যাকসিনের অনুমোদন পায়নি।
অধ্যাপক খুরশিদ আরও জানান, সরকার এখন চীনা ভ্যাকসিন সম্পর্কিত বিধিবিধান নিয়ে কাজ করছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগে অক্সফোর্ডের টিকার অনুমোদন দিয়েছি। সিনোফার্মের টিকার ক্ষেত্রেও আমরা সেটাই বিবেচনা করছি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিষয়টি তদারকি করছেন।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, ভারত সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার রপ্তানি সাময়িকভাবে স্থগিত করার পর সময়মত টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে বাংলাদেশ। টিকার এই সংকট কাটাতে অন্যান্য উদ্ভাবকদের কাছ থেকে টিকা কেনার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে সরকার। এ জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এতে চীনের সিনোফার্ম বাংলাদেশকে টিকা দিতে আগ্রহী হয়। একই সাথে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি নিয়েও সরকারের সফল আলোচনা হয়েছে বলে জানান।
সরকারের একটি চিঠি থেকে জানা যায়, গত ১৫ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়ে ‘চীন সরকারকে টিকার জন্য অনুরোধ জানাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে’ বলেছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন ট্রাকারের ভাষ্য অনুযায়ী, গত ৩০ ডিসেম্বর সিনোফার্ম ঘোষণা দিয়েছিল যে এ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হার ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। যার ফলশ্রুতিতে চীন সরকার এটিকে অনুমোদন দেয়।
তবে প্রতিষ্ঠানটি এখনো তাদের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের বিস্তারিত ফলাফল প্রকাশ করেনি।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাত জানুয়ারিতে সিনোফার্মার ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দেয় এবং জানায় যে এর কার্যকারিতা ৮৬ শতাংশ।
ইতোমধ্যে চীনে তৈরি এই ভ্যাকসিনটি বাহরাইন, চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ (ট্রায়াল) যৌথ গবেষণা ও উৎপাদনের কারখানাও স্থাপন করতে চেয়েছে আনুই জিফেই লংকম বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি চীনা প্রতিষ্ঠান। তাদের টিকা পরীক্ষা সফলভাবে শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশে যে টিকা উৎপাদিত হবে, তার একাংশ মুজিব বর্ষের উপহার হিসেবে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রদান করবে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) টিকা পরীক্ষার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে আনুই জিফেইকে চিঠি দিয়েছে।
বিএসএমএমইউ’র ভিসি প্রফেসর ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, চূড়ান্ত কিছু এখনো হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনুই জিফেই’র সঙ্গে গবেষণায় যুক্ত হওয়ার বিষয়ে চিঠি দেয়াসহ অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ও বিষয়টিতে আগ্রহী বলে উল্লেখ করেন তিনি।
যদিও গত বছরের সেপ্টেম্বরে আনুই জিফেই নিজেদের টাকায় বিএসএমএমইউ’র সঙ্গে করোনার টিকা পরীক্ষার প্রস্তাব দেয়। পরীক্ষা সফল হলে তারা বাংলাদেশে টিকার গবেষণার পাশাপাশি টিকা উৎপাদনের কারখানা স্থাপনেরও কথা বলে ওই প্রস্তাবে।
এর আগে চীনের টিকা উদ্ভাবন ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক তাদের টিকার পরীক্ষার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষায় অর্থায়ন-জটিলতায় সেই উদ্যোগ এগোয়নি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রাশিয়ার ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক ভি’ সংগ্রহে ‘প্রাথমিক অগ্রগতি’ অর্জন করেছে বলেও জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি টিকা কেনার ব্যাপারেও আলোচনা চলছে’।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন ট্রাকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৯১ দশমিক ছয় শতাংশ। এটি ৬০টি দেশে জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেয়েছে।
এদিকে ইউএনডিপির অর্থায়নে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার তিন কোটি ডোজ কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফের মাধ্যমে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে এ টিকা কেনা হবে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এডিবি বাংলাদেশকে ৯৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের অঙ্গীকার করেছে, সেখান থেকে জনসনের ভ্যাকসিন মূল্য পরিশোধ করা হবে। এপ্রিল মাসে এ ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইউনিসেফের প্রকিউরমেন্ট সাপ্লাই ডিভিশনের মাধ্যমে টিকা কেনা হবে। এ ছাড়া টিকা কেনার জন্য জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ৫০ কোটি ডলার, এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) ৫০ কোটি ডলার, ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক ২৫ কোটি ডলার অর্থায়ন করার আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশের টিকা কেনার কাজে অর্থায়নে ফ্রান্স সরকারও আগ্রহী। তবে দেশটি কী পরিমাণ অর্থায়ন করবে, তা বলেনি।
গত নভেম্বরে নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ‘কোভিশিল্ড’ টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে সরকার। টিকার দাম পরিশোধ করা হয় অগ্রিম। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে আসার কথা। গত জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ টিকা এলেও ফেব্রুয়ারিতে এসেছে ২০ লাখ ডোজ। চলতি মাসে কেনা টিকার চালান এসে পৌঁছেনি। তবে দুই দফায় বাংলাদেশকে ৩২ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে দিয়েছে ভারত। আগামী ৭ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় ডোজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে চুক্তি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি ও মার্চে টিকা সরবরাহ করতে পারেনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট। এ দুই মাসে ৮০ লাখ ডোজ টিকা কম সরবরাহ হয়েছে। এতে দেশে চলমান টিকা কার্যক্রমে প্রথম পর্যায়ের দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা কেনার চুক্তি থাকলেও ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে সময়মত টিকা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে একটি টিকার ওপর নির্ভর না থেকে একাধিক উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এই প্রেক্ষাপটে চীনের সিনোফার্ম ব্যবহারের সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক বলে মনে করেন তারা। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের উপর নির্ভরশীল না হয়ে অন্যান্য উৎস থেকে টিকা প্রাপ্তির বিষয়ে সরকারের এগিয়ে যাওয়া প্রসংশনীয় উদ্যোগ। এতে দেশ ভয়াবহ করোনাক্রান্তি পেতে যাচ্ছে বলে যে আশঙ্কা ছিল তাতে অনেকটাই লাঘব হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ