দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি রুখতে সারাদেশে গতকাল সোমবার (০৫ এপ্রিল) থেকে শুরু হয়েছে ২য় দফায় লকডাউন। লকডাউন কার্যকরের জন্য মাঠে রয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সাথে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের লোকজন। লকডাউন কার্যকরে তারা লোকজনকে সতর্ক করার জন্য ও অহেতুক বের না হবার জন্য কর্মসূচি চালিয়ে গেলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়িত্বরত ইউএনওদের লোকজনের প্রতি অমানবিক আচরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে লোকজন ক্ষেপে গিয়ে ইউএনওদের অবরোধ করে রাখা সহ উপজেলা পরিষদে হামলা করার অভিযোগও এসেছে।
যুবককে পেটানোয় কলাপাড়ায় ইউএনও অবরুদ্ধ
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সচেতনতামূলক প্রচারনাকালে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এক যুবককে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয়রা। এসময় ইউএনওকে প্রায় আধঘণ্টা আবরুদ্ধ করে রাখা হয়।
গতকাল সোমবার রাত ৮টার দিকে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ইউএনওকে ঘটনাস্থলে অবরুদ্ধ করে রাখলে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে পুলিশের ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে চলমান লকডাউন কার্যকর করতে ও সচেতনতামূলক প্রচারণার জন্য কলাপাড়ার ইউএনও আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদুল হক কুয়াকাটা চৌরাস্তায় কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। এসময় একটি ‘তালাশ’ পত্রিকার স্টিকার লাগানো মোটরসাইকেল চালিয়ে ইলিয়াস শেখ সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় ইউএনও তাকে থামিয়ে পরিচয় জানতে চান।
ইলিয়াস শেখ সাংবাদিক বলে নিজের পরিচয় দিলে ইউএনও বেধড়ক মারধর করেন। ইউএনও’র নির্দেশে তিন পুলিশ সদস্য ও এক আনসার সদস্য ওই যুবককে এলোপাথাড়ি পেটাতে থাকেন। ইউএনও নিজেও কিল-ঘুষি ও লাথি মারেন।
এমন নির্যাতন দেখে স্থানীয়রা উত্তেজিত হয়ে ইউএনও’র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো শুরু করেন। তারা ইউএনওকে সেখানে প্রায় আধা ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন।
পরে মহিপুর থানা পুলিশ ও কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ অবরুদ্ধ ইউএনওকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। রাত ৯টার দিকে পুলিশ উত্তেজিত জনতাকে মাইকিং করে সরিয়ে দেওয়ার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়।
ইউএনও আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদুল হক বলেন, ‘চলমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত কঠোর নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে গেলে ইলিয়াস শেখ বাধা প্রদানসহ আমাকে লাঞ্ছিত করেন এবং গাড়িসহ আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে পুলিশ এসে আমাকে উদ্ধার করে।’
শেবাচিমে চিকিৎসাধীন ইলিয়াস শেখ বলেন, ‘আমি মোটরসাইকেল চালিয়ে কুয়াকাটা চৌরাস্তায় এলে ইউএনও সাহেব আমাকে থামিয়ে পরিচয় জানতে চান। পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেল থেকে আমাকে টেনে নামিয়ে মারধর করেন।’
মহিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, ‘খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে উত্তেজিত জনতাকে সরে যেতে অনুরোধ করলে তারা ফিরে যান। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন।’
ফরিদপুরের সালথায় বিক্ষোভ, হামলা, নিহত একজন
এদিকে ফরিদপুরের সালথায় বাজারে লোক সমাগম ও দোকানপাট খোলা দেখতে পেয়ে এসিল্যান্ডের সহকারী একজনকে লাঠিপেটা করে। আর এনিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে স্থানীয়ারা।এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে থানা ও উপজেলা কমপ্লেক্স ঘেরাও করে রেখেছে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও জনতা।
জানা গেছে, সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে সালথা উপজেলা সদর থেকে আনুমানিক সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে সোনাপুর ইউনিয়নের ফুকরা বাজার থেকে এ সংঘাতময় পরিস্থিতির সূত্রপাত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ওই সময় অস্ত্রধারী আনসার সদস্য ও পিএকে নিয়ে এসিল্যান্ড মারুফা সুলতানা ফুকরা বাজারে যান। এসময় বাজারে লোক সমাগম ও দোকানপাট খোলা দেখতে পেয়ে এসিল্যান্ডের সহকারী একজনকে লাঠিপেটা করে। আর এনিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে স্থানীয়ারা। স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে এসিল্যান্ড তার টিম নিয়ে উপজেলায় ফিরে আসেন।
পরে সালথা থানার পুলিশ ফুকরা বাজারে গিয়ে জনতার সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসময় এসআই মিজান ও দুই কনস্টেবল আহত হন। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ফুকরা বাজারে এলে জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং পুলিশের উপর হামলা চালায়। পরে পুলিশ থানায় চলে আসে।
জানা গেছে, সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সালথা উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের ফুকরা বাজারে চা খেয়ে ওই ইউনিয়নের নটাখোলা গ্রামের মৃত মোসলেম মোল্যার ছেলে জাকির হোসেন মোল্যা বাড়ি ফিরছিলেন। এসময় লকডাউনের কার্যকারিতা পরিদর্শনে সেখানে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা খান হিরামনি উপস্থিত হন।
জাকির হোসেন অভিযোগ করেন, কিছু বুঝে উঠার আগেই এসিল্যান্ডের গাড়ি থেকে নেমে এক ব্যক্তি তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। এতে তার মাজা ভেঙে যায়। আহত জাকির হোসেনকে উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে, জাকির হোসেনের আহত হওয়ার খবরে সেখানে উপস্থিত জনতা উত্তেজিত হয়ে উঠে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে আরও গ্রামবাসী জড়ো হয়। এরপর সেখানে সালথা থানার এসআই মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ পৌঁছালে উত্তেজিত জনতা পুলিশের ওপরেও হামলা করে। এতে এসআই মিজানুর রহমানের মাথা ফেটে যায়। এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা সালথা থানা ঘেরাও করে। এ সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ গুলি ছুঁড়ে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
এতে জোবায়ের মোল্লা নামে স্থানীয় একজন নিহত হয় এবং রাতেই তার পরিবার তাকে দাফন করে।
অপরদিকে রাত ১০টার দিকে এসিল্যান্ডের অফিসে ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধরা।
পুলিশের ভাষ্য, গতকাল সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সালথায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে। সংঘর্ষের ঘটনায় ৭ পুলিশ সদস্যসহ ১০ জন আহত হয়েছেন। পুলিশ ও আনসার সদস্যরা শটগানের ৫৮৮টি গুলি ও ৩২টি কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, লকডাউন কার্যকরে লোকজনের সাথে ইউএনওরা প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ করেন। লকডাউনের প্রথম দফায়ও এমন অনেক অভিযোগ আসে। লোকজন করোনা মহামারি নিয়ে এখনো সচেতন নয়, এটা যেমন সত্য, একইভাবে রাজধানী ব্যতিত দেশের অন্যান্য স্থানে করোনা বিষয়ে মানুষজন অতোটা ওয়াকিবহালও নয়। লোকজনকে সচেতন করার জন্যই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের অন্যান্য লোকদের কাজ করে যেতে হবে। এজন্য কারও ওপর হাত তোলা, মারধর করা, গালাগাল দেওয়া এসব যেমন অমানবিক তেমনি আইন বিরুদ্ধ। ইউএনওদের অতিরিক্ত কর্তৃত্বসূলভ আচরণ লোকজনের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়, এতে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হওয়াটাও স্বাভাবিক। তবে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মত ঘটনাও সমর্থনযোগ্য নয়। এবিষয়ে লকডাউন কার্যকরে দায়িত্বরতদের সচেতন থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৮
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ