ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চিকে বন্দি করার পর মিয়ানমারে এখন চলছে সামরিক শাসন। এই সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ পুরো বিশ্ব তোলপাড়। গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে একসময় বিশ্বের অন্যতম রোল মডেলে পরিণত হয়েছিলেন অং সান সুচি। ক্ষমতায় এসে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অন্যতম ভিত্তি, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় তার ব্যর্থতা বৈশ্বিকভাবে তার অর্জনকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। গণতন্ত্রের নায়ক থেকে তিনি পরিণত হয়েছেন সংখ্যালঘুদের নিপীড়নকারী খলনায়ক হিসেবে।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান
২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি। এরপর ক্ষমতার ভাগাভাগি আর সেনাপ্রধানের মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে সামরিক বাহিনীর সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় সু চির এনএলডির দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের প্রাক্কালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় সামরিক বাহিনী তাতমাদৌ।
ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় আইনসভার নতুন অধিবেশনের আগে অভ্যুত্থান ঘটায় সামরিক বাহিনী। শুরুর দিকে সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলন সীমিত পরিসরে হলেও, সময়ের সাথে বাড়ে আন্দোলনের ব্যাপ্তি, বাড়ে সাধারণ নাগরিকদের অংশগ্রহণ।
এক দশক ধরে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোর দিকে এগিয়ে যাওয়া মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জনসংখ্যার তরুণ অংশটি।
সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার প্রথম দুই মাসে প্রায় অর্ধ-সহস্র মানুষ নিহত হয়েছে সামরিক বাহিনীর হাতে, আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর সহিংসতার শিকার হচ্ছেন অগণিত মানুষ।
স্বাধীনতার পর থেকেই মিয়ানমারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয় সামরিক বাহিনী, স্বাধীনতার দ্বিতীয় দশকেই ক্ষমতা দখল করে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এরপর পরবর্তী পাঁচ দশকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় টিকে থাকতে নিষ্ঠুরভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো দমন করেছে, নিজেদের জাতির স্বঘোষিত অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বেশ কয়েকবারই নিতে হয়েছে বর্বর ভূমিকা। নিজেদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার চর্চা টিকিয়ে রাখতে এবারেও জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করেছে সামরিক বাহিনী।
মিয়ানমারে সেনাবিরোধী বিক্ষোভে গতকাল শনিবার পুলিশের গুলিতে অন্তত পাঁচ জন নিহত হয়েছেন। গতকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশটিতে ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ করে দিয়েছে সামরিক সরকার।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দেশটিতে গুলিতে পাঁচ বিক্ষোভকারীর নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মনিওয়া শহরে তিন জন, বাগো শহরে এক জন ও দক্ষিণে থাটন শহরে এক জনের মৃত্যু হয়েছে।
এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৫৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৪৬ জন শিশু।
দমন-নিপীড়নের পরেও প্রতিবাদকারীরা প্রতিদিন রাস্তায় নামছেন, বিক্ষোভ করছেন। রাতেও মোমবাতি জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন।
মিয়ানমারে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ক্ষমতাসীন সেনা সরকার। সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে সেনাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর দমন-নিপীড়নের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেনা সরকারের বিরোধী আন্দোলন জোরালো হতে শুরু হয়।
সেনা সরকার ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করলেও সমালোচকরা ভিপিএনসহ বিকল্প পদ্ধতিতে ফেসবুক ব্যবহার চালিয়ে যায়। এর আগে দেশটিতে মোবাইল ডেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। গতকাল থেকে কন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবাও। ফলে, দেশটিতে ইন্টারনেট ব্যবহার কমে গেছে। তবে, এখনও কিছু পোস্ট ও ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে।
অনলাইনে সেনা সরকারের বিরুদ্ধে যারা সমালোচনা করছেন তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করছে সামরিক সরকার।
অং সান সু চির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
পশ্চিমা বিশ্বের কাছে সু চি ছিলেন আজীবনের প্রেসিডেন্ট। নির্বাচিত নেতারা যেসব মূল্যবোধের কথা বলে থাকেন তিনি যেন ছিলেন তাদের কাছে সেরকমই এক আলোক-বর্তিকার মতো। তবে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করা অথবা তাদেরকে সমর্থন দিতেও অস্বীকৃতি জানানোর কারণে পরে তিনি তাদের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছেন।
রোহিঙ্গা সংকটের কারণে সু চির বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা কমলেও, অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমারকে আত্মপক্ষ সমর্থন করা দলের নেতৃত্ব দেওয়ায় আবির্ভূত হন জাতীয় বীর হিসেবে। ফলে, ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি।
একটা দীর্ঘ সময় সু চি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কাজ করেছেন রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে। আশির দশকের শেষদিকে রাজনীতিতে প্রবেশ করা অং সান সু চি হয়ে উঠেছিলেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকাশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু, সেনাশাসিত মিয়ানমারে অং সান সু চির আর উজ্জ্বল কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। তার পেছনে কারণ নানাবিধ।
প্রথমত, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান সু চির ফিরে আসার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। মিয়ানমুর জুড়ে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে চলছে আন্দোলন। আর বিরোধী আন্দোলন থামাতে মধ্যরাতে নাগরিকদের ঘরবাড়িতে হানা দিচ্ছে সেনাবাহিনী, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে আন্দোলনকারীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করছে, সামরিক বাহিনীর যানগুলো রাতে টহল দিচ্ছে আবাসিক এলাকাগুলোতে।
এরমধ্যে বিমান হামলার কারণে প্রায় নয় হাজার কারেন বাধ্য হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আশ্রয় নিতে। ভেঙে পড়েছে ন্যাশনাল কেইস ফায়ার এগ্রিমেন্টের কাঠামো, যুদ্ধ বিরতির চুক্তিতে আসা গোষ্ঠীগুলো অস্বীকৃতি জানাচ্ছে সামরিক বাহিনীর সাথে আলোচনায় বসতে।
স্বাধীনতার পর থেকেই গৃহযুদ্ধ চলছে মিয়ানমারে, এরমধ্যে মূলধারার রাজনৈতিক আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালানোর পাশাপাশি সহিংসতাগুলো সম্ভাবনা তৈরি করছে আরেকটি বড় পরিসরে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার। সেরকম কিছু হলে মিয়ানমারে খুব দ্রুত গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই, সম্ভাবনা নেই মূলধারার রাজনীতিতে অং সান সু চির প্রত্যাবর্তনেরও।
দ্বিতীয়ত, সু চি যেসব মূল্যবোধের জন্য বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, তার উল্টো কাজ করেছেন প্রায় অর্ধযুগের স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে। সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যতটুকু ক্ষমতা ছিল, তিনি সেটি কেন্দ্রীভূত করেছিলেন নিজের হাতে, প্রশাসনকে নিয়ে আসতে চাইছিলেন নিজের নিয়ন্ত্রণে।
নিজের অনুগত লোকদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ক্ষমতায়ন করেননি সিভিল সোভাইটিকে। গণমাধ্যমের ছিল না মত প্রকাশের অধিকার। সবমিলিয়ে নিজের ক্ষমতাকে সংহত করতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর মতো তিনিও ঝুঁকে যাচ্ছিলেন একনায়কতন্ত্রের দিকে।
তার এই ভূমিকার কারণে এমন কোনও প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি, যেটি সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারবে কিংবা এই অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বের করে নিয়ে আসার মতো দক্ষতা দেখাবে।
সু চির এই ব্যর্থতা নিশ্চিত করেছে, খুব দ্রুতই সমাধান হচ্ছে না এই রাজনৈতিক সংকটের। ফলে, পচাত্তর পেরিয়ে যাওয়া সু চির জন্য রাজনীতিতে ফিরে আসাটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। হয়তোবা, এই অনিশ্চয়তাকে সামনে রেখে নিজেকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কাঠামো থেকে সরিয়ে নেবেন তিনি।
তৃতীয়ত, রাখাইন এবং অন্যান্য অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে, বিনিয়োগ এসেছে জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ থেকে। বিনিয়োগ এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো কাঠামো থেকেও। এই বিনিয়োগগুলো সামরিক বাহনীর জন্য রক্ষাকবচের মতো কাজ করছে। অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে এই দেশগুলো, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ নিয়েও।
এই সিদ্ধান্তহীনতার পাশপাশি সামরিক বাহিনীর প্রতি চীনের সমর্থন সেনাশাসন দীর্ঘায়িত করবে মিয়ানমারে। সেনাশাসন দীর্ঘায়িত হলে, আগামী দিনগুলোতে হয়তো আবারো গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হবে অং সান সু চিকে।
চতুর্থত, মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম একটি ইতিবাচক দিক হলো, সু চির নির্দেশনা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন সাধারণ নাগরিকেরা। অভ্যুত্থানে বিরোধী আন্দোলনে তারা যুক্ত হচ্ছেন নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন থেকে, আন্দোলনের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
আগামী দিনগুলোতে এই তৈরি হওয়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিস্থাপন করবে সু চির প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের। গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য বটবৃক্ষ কখনোই ভালো কিছু না। বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব উঠে আসলে একসময় হয়তো সু চির যুগের ‘বটবৃক্ষ’ প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে মিয়ানমার, যেটা দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক হবে গণতন্ত্রের জন্য
এসডব্লিউ/এসএন/এসএস/১৪২০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ