করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় ফের লকডাউনে যাচ্ছে পুরো দেশ। আগামী সোমবার (৫ এপ্রিল) থেকে সারাদেশে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। এদিকে লকডাউনের খবর শুনে রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন বাজারে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।
জানা যায়, লকডাউন চলাকালে জরুরি সেবা দেয় সেসমস্ত প্রতিষ্ঠান সমূহ খোলা থাকবে। আর শিল্প কলকারখানা খোলা থাকবে। যাতে করে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং বিভিন্ন শিফটিংয়ের মাধ্যমে কাজ করতে পারে।
জানা যায়, লকউনের মুখ্য উদ্দেশ্য হবে অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা ও সভা-সমাবেশ বন্ধ রাখা। যদি কোনো মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছাতে চায় সেক্ষেত্রে কিছুটা সময় দিয়ে লকডাউন কার্যকর করার চিন্তা চলছে।
এদিকে আগামী সোমবার থেকে লকডাউন শুরু হতে যাচ্ছে— এমন ঘোষণা শোনার সাথে সাথে লোকজন ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে। ঢাকা ছাড়ার কারণ হিসাবে যাত্রীরা জানিয়েছেন, লকডাউনে আনীত নিয়মকানুন তাদের পক্ষে মানা কষ্টকর, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসা থেকে বের হওয়া, বজায় রাখা ইত্যাদি ঝামেলা থেকে মুক্ত হবার জন্যই গ্রামের পথে রওনা হওয়া। এছাড়া গত লকডাউনে মানবেতর জীবন যাপনের কষ্টকর দিক বিবেচনা করেও অনেকে ঢাকা ছাড়ছেন।
তবে লকডাউনে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়া লোকজন এক সপ্তাহের জন্যই যাচ্ছেন বলে জানালেন। এজন্য দেশের বাস ট্রেন ও লঞ্চ টিকিট কাউন্টারে যাত্রীদের বাড়ি ফেরার তাড়া।
গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, গাবতলী ইত্যাদি বাস স্টেশনেও লোকজনের ভিড় দেখা যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে লকডাউনের খবর শোনার পরই রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে আতঙ্কের কেনাকাটা বা প্যানিক বায়িং শুরু হয়ে গেছে। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বাজারে ভিড় করছে। কেউ কেউ একসঙ্গে বাড়তি পরিমাণ পণ্য কিনে ঘরে ফিরছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, লকডাউনের খবরে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে আতঙ্কের কেনাকাটা বা প্যানিক বায়িং শুরু হয়ে গেছে। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বাজারে ভিড় করছে। কেউ কেউ একসঙ্গে বাড়তি পরিমাণ পণ্য কিনে ঘরে ফিরছেন।লকডাউন পরিস্থিতির বিবেচনা করে অনেক মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মজুদ শুরু করেছেন। নগরীর শপিংমলগুলোতেও লোকজনের প্রচন্ড ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। লকডাউনের খবরে ঈদের কেনাকাটাও সেরেছেন কেউ কেউ।
শনিবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত রাজধানীর অন্যতম বড় তিন বাজার মোহাম্মদপুরের টাউন হল, হাতিরপুল ও কারওয়ান বাজারে ক্রেতাদের বাড়তি ভিড় দেখা যায়। বেশিরভাগ মানুষ সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য—চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ও আলু কিনছিলেন।
এদিকে সংবাদ মাধ্যম মারফতে জানা যায়, লকডাউনের খবরে চট্টগ্রামে মুদি দোকানে ভিড় করছেন ক্রেতারা। নগরীর প্রধান পাইকারী বাজার চাকতাই-খাতুনগঞ্জেও হঠাৎ বেড়ে যায় ক্রেতা চাপ। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে খুচরা বিক্রেতারা জিনিসপত্র কিনতে আসায় রীতিমতো ঠাসা-ঠাসিতে পরিণত হয় চাকতাই-খাতুনগঞ্জে।
এদিকে শনিবার বেলা ৩টার দিকে নগরীর বহদ্দারহাট কাচাবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। কেউ কেউ সাতদিন কিংবা পনের দিনের জন্য পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বাজারে ক্রেতার চাপ বেড়ে যাওয়াতে চাল, ডালসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্য পণ্যে কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা করে বেশি নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
শুধু নগরীতে নয়, একই পরিস্থিতি চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোতেও। রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী বাজারের শাহাজাহান স্টোরের মালিক মো. শাহজাহান জানান, লকডাউনের ঘোষণা শোনে লোকজন দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে ভিড় শুরু করে। যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি।
রাজধানীর অন্যতম বড় বাজার কারওয়ান বাজারের সরকারি অফিসগুলোতে শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। তারপরও ভিড় অন্যান্য ছুটির দিনের তুলনায় বেশি দেখা গেল। প্রাইভেট কার থামিয়ে অনেকেই কেনাকাটা করছিলেন। তাদের একজন মোহাম্মদপুরের জামাল হোসেন। তিনি জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির এই পরিস্থিতিতে বারবার যাতে বাজারে না আসতে হয়, তাই বাড়তি পরিমাণে কিনেছি।
দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে গত বছরের ৮ মার্চ। এরপর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হয়। তখন সাধারণ ছুটির আগে বাজারে ব্যাপক ভিড় হয়েছিল। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেশ বেড়ে যায়। এ বছর চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগে থেকেই চড়া।
তবে হাতিরপুল বাজারের ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হক বলেন, চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ইত্যাদির সরবরাহে ঘাটতি নেই। তিনি মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেন।
বিক্রেতারা বলছেন, দুপুর থেকেই ক্রেতারা শুকনো পণ্য- পেঁয়াজ, আলু, ডিম বেশি করে কেনা শুরু করেছেন। বর্তমানে পণ্যগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম রয়েছে। ক্রেতারা যেভাবে পণ্য কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন, তাতে যেকোনো মুহূর্তে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। তবে ক্রেতারা অস্বাভাবিক আচরণ না করলে দাম বাড়ার তেমন সম্ভাবনা নেই।
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী রুবেল মিয়া বলেন, ‘সকালে যখন লকডাউনের খবর শুনেছি তখনই ধরে নিয়েছি যেকোনো মুহূর্তে ক্রেতারা বাড়তি কেনাকাটা শুরু করবে। সেরকম প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলাম। দুপুরের পর থেকেই ক্রেতাদের ভিড় বেড়ে যায়। পর্যাপ্ত পণ্য থাকায় দাম বাড়েনি।’
কারওয়ান বাজার থেকে পণ্য কেনা আশরাফ আলী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সোমবার থেকে লকডাউন দেয়া হচ্ছে। তখন পরিস্থিতি কী হবে বলা মুশকিল। এখন যেহেতু আলু, পেঁয়াজের দাম কম আছে তাই কিছুটা বাড়তি কিনে রাখছি। বাংলাদেশের বাজারে কখন কী হয় তার বিশ্বাস নেই।’
এদিকে লকডাউনের খবর গণমাধ্যম ও সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর মানিকগঞ্জে বাজারে নিত্যপণ্য কেনার জন্য ক্রেতারা ভিড় করেন। তবে লকডাউনের খবরে শহরের বিপণিবিতানগুলো ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে।
মাছ বিক্রেতা বাহার উদ্দিন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, যে পরিমাণ মাছ বাজারে আনেন, তা বিক্রি করতে অনেক রাত হয়ে যায়। তবে দুপুরে লকডাউনের খবরের পর থেকে মাছ বিক্রি বেড়ে গেছে। বিকেলের মধ্যে সব মাছ বিক্রি হয়ে গেছে।
শহরের বাসিন্দা তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘সাত দিনের লকডাউনে পরিবহন বন্ধ থাকায় সবজির সরবরাহ কমে যেতে পারে। সরবরাহ কমে গেলে দামও বেড়ে যেতে পারে। তাই কয়েকদিনের সবজি একসঙ্গে কিনে নিয়ে যাচ্ছি।’
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আজ শনিবার সকালে প্রথম ‘লকডাউনের’ খবর জানান। এরপর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ‘লকডাউনের’ সিদ্ধান্তের কথা জানান। বাজারে ভিড় বাড়তে শুরু করে বেলা দুইটার পর থেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে এমনিতেই বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য নাগালের বাইরে। তার ওপর সামনের রোজাকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর মজুদ বাণিজ্য বেড়ে গেছে। এদিকে লকডাউনের খবর শুনে মানুষ বাজারগুলোতে ভিড় জমাচ্ছে। এর প্রভাব অবশ্যই দ্রব্যমূল্যের ওপর পড়বে। সামনের দিনগুলোতে অস্বাভাবিক দামে খাদ্যপণ্য কিনতে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
তারা বলেন, সরকার ইতিমধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। রোজাকে সামনে রেখেও সরকারের দ্রব্যমূল্য নিয়ে বাড়তি কোনো পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। এতে খাদ্যপণ্যের বাজার অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এখনো বাজার নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু ক্রেতা সাধারণের ভাষ্যমতে এখনি বাজারে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য স্বাভাবিকের বাইরে।
তারা বলেন, সামনের লকডাউন ও রোজায় বাজারের নিয়ন্ত্রণ জনগণের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। নইলে এই লকডাউনে মানুষের তিন বেলা খাওয়াও কষ্টকর হয়ে যাবে। আর যারা দিনমজুর তাদের কষ্ট আরও দ্বিগুণ হবে। তাই সরকারকে এখনি বাজারের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০২
আপনার মতামত জানানঃ