গত বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাপী মানুষজন নতুন একটি শব্দ শিখেছে। আর তা হল করোনাভাইরাস। এটি এমন এক ভাইরাস যা স্তব্ধ করে দিয়েছে পৃথিবীর প্রাণচাঞ্চল্য। করোনাভাইরাসের মহামারিতে চরম ঝুঁকির মুখে আছেন গর্ভবতী নারী এবং তাদের অনাগত সন্তানরা। গবেষকরা বলছেন, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে, কয়েক দশকের নিরাপদ মাতৃত্ব অর্জনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।
গত বছর প্রকাশিত ১৭টি দেশের প্রায় ৪০টি গবেষণাপত্র বিশ্লেষণের ফলাফল অনুযায়ী মাতৃমৃত্যু এবং শিশু মৃত্যুর হার এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বুধবার (৩১ মার্চ) মেডিকেল সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশগুলোর পরিস্থিতি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উঠে এসেছে।
গবেষণার তথ্যানুযায়ী, কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে লকডাউনের মতো ব্যবস্থাগুলোর জন্য নয় বরং, স্বাস্থ্য খাতে কোভিড-১৯ এর কারণে চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় মাতৃমৃত্যুর হার বেড়েছে। বিভিন্ন দেশের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, সংক্রমণের ভয়ে গর্ভবতী নারীরা তাদের স্বাস্থ্য সেবা নেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। একই সাথে, মাতৃত্বকালীন পরিষেবাগুলোর ব্যবস্থা কমে যাওয়ায় গর্ভবতী নারীদের ঝুঁকির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেন্ট জর্জের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে গবেষণাটির প্রধান লেখক আসমা খলিল বলেন, “আমাদের গবেষণায় একটি বিষয় পরিষ্কার যে, মা ও শিশুদের যে মৃত্যুগুলো এড়ানো যেত, মহামারির প্রতিবন্ধকতার কারণে আমাদের সেই মৃত্যুগুলোর সম্মুখীন হতে হয়েছে।”
মেটা অ্যানালাইসটিতে ব্রাজিল, বটসওয়ানা, কানাডা, চীন, ডেনমার্ক, ভারত, ইসরায়েল, মেক্সিকো, নেপাল যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৭ টি দেশের গবেষণা পত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে। জন হপকিনস ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য এবং গাইনোকলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার অ্যান্ড্রে ক্রেঞ্জা বলেন, গবেষণার ফলাফল বলছে মা ও শিশুর জন্য নিরাপদ গর্ভাবস্থার সাম্প্রতিক উন্নতির বিপরীত দিকে হাঁটছে বিশ্ব।
সন্তান জন্মদান এবং প্রসবকালীন যত্নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষায় বিশ্ব অভাবনীয় অগ্রগতি লক্ষ্য করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মনোযোগ ছিল গর্ভবতী নারী ও শিশুদের সেবার মান উন্নয়নের দিকে।
“বর্তমানে আমরা আবারও পেছনের দিকে ফিরে যাচ্ছি। নারীরা যেন নিজেদের এবং অনাগত সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পায় তা নিশ্চিত করুন। সামনের পথ অত্যন্ত কঠিন,” বলেন তিনি।
এদিকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আফরোজা কুতুবী বলেন, গর্ভাবস্থায় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। অন্যান্য ভাইরাসের পাশাপাশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণও হতে পারে। গর্ভবতী এবং সদ্য সন্তানের জন্ম দিয়েছেন (বিশেষত ২ সপ্তাহের মধ্যে), এমন মায়েদের বিশেষ সাবধানে থাকা উচিত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাঈদা আনোয়ার বলেন, শিশুদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কম। বিশেষত ০-৯ বছর বয়সের মধ্যে সংক্রমণ হয় না বললেই চলে। শিশুদের ওপর এর প্রভাব কম হলেও ওদের নিয়ে অসতর্ক হওয়ার সুযোগ নেই। করোনাভাইরাস ছাড়াও অন্য জীবাণুদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। এই শিশুদের শরীরে জীবাণু প্রবেশ করলে ওদের মাধ্যমেও সংক্রমিত হতে পারেন পরিবারের অন্যরা। তাই ঝুঁকি এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। যদিও ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি খানিকটা কম, তবে যেসব শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, তাদের ঝুঁকির মাত্রা বেশি হতে পারে।
মা ও শিশুর জন্য
করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সাধারণ নিয়মগুলোই বিশেষভাবে মেনে চলার পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া মা ও শিশুর সার্বিক পরিচর্যা তো চলবেই অন্য সময়ের মতো।
- ভিড় এড়িয়ে তো চলতেই হবে মা ও শিশুকে। দোকানপাট, অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলুন। ঘরের বাইরে না যাওয়াই ভালো। বাইরে গেলেও সম্ভব হলে লিফট এড়িয়ে চলুন।
- গণপরিবহন এড়িয়ে চলা ভালো। গর্ভবতী মাকে কাজের জন্য বাইরে যেতে হলেও তার জন্য ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো। সেটিও ভাড়ায় চালিত বাহন (যা অন্যরাও ভাড়া করতে পারে, যেমন অনলাইনভিত্তিক পরিবহনসেবা) না হয়ে একান্ত নিজের বাহন হলে সবচেয়ে ভালো।
- মা অফিসে গেলেও নিজের ডেস্কেই থাকুন। নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে অনেকের সঙ্গে একই কক্ষে অবস্থান না করা ভালো। বাইরের খাবার না খেয়ে ঘর থেকে ভালোভাবে রান্না করা খাবার নিয়ে বেরোন।
- পরিবারের অন্যরা বাইরে থেকে ফিরেই মা কিংবা শিশুকে স্পর্শ করবেন না, শিশু দৌড়ে এলেও না। যেকোনো সময় মা কিংবা শিশুকে স্পর্শ করতে হলে আগে নিয়মমাফিক সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। না পেলে অ্যালকোহল সমৃদ্ধ হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। বাড়িতে ঢুকতেই হাত পরিষ্কারের ব্যবস্থা রাখতে পারেন। যিনিই বাইরে যান না কেন, বাইরের জুতা বাইরেই রাখুন। ঘরে ফিরে বাইরের কাপড় ছেড়ে ফেলুন। সম্ভব হলে তখনই সাবান দিয়ে ধুয়ে নিন এবং নিজেও সাবান দিয়ে গোসল করে নিন।
- শিশু একটু বড় হলে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশি ঢাকা, কফ-থুতু ফেলার নিয়ম শেখান এবং তাকে বারবার মনে করিয়ে দিন। শেখান হাত না ধুয়ে চোখ-নাক-মুখে হাত দেওয়া যাবে না। পরিবারের সবাইকেই এসব নিয়ম মেনে চলতে হবে অবশ্যই।
- ঘরের যেসব স্থান বারবার স্পর্শ করা হয়, তা জীবাণুমুক্ত রাখুন।
- মায়েদের পুষ্টিকর খাবার দিন (আমিষ ও ভিটামিন সি জাতীয় খাবারও থাকবে সুষম খাদ্যতালিকা অনুসরণ করে)।
- শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। প্রতিদিন কাপড় বদলে দিন।
- শিশুকে ঠোঁট দিয়ে আদর না করাই ভালো।
- নিয়মমাফিক বুকের দুধ দিন শিশুকে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রথম ৬ মাস মায়ের দুধ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
- মায়ের ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ প্রভৃতি থাকলে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট জটিলতায় তারাই বেশি পড়েন, যাদের বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি অসুখ রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩১৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ