
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের সরকারি নির্দেশনার প্রেক্ষাপটে চলাচল সীমিত করতে গিয়ে সারাদেশে গণপরিবহনরে ভাড়া ইতিমধ্যে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যা কার্যকর হচ্ছে গতকাল থেকে। এবার লঞ্চে ডেকের ভাড়া বাড়লো ৬০ শতাংশ। তবে কেবিনের ক্ষেত্রে কোনো ভাড়া বাড়বে না। বর্ধিত ভাড়া আজ বৃহস্পতিবার(১ এপ্রিল) থেকেই কার্যকর হবে।
আজ বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) দুপুরে সচিবালয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।
অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলের ক্ষেত্রে আগে লঞ্চের ডেকের ভাড়ার হার ছিল ১০০ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য জনপ্রতি এক কিলোমিটারে এক টাকা ৭০ পয়সা। ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব অর্থাৎ ১০০ কিলোমিটার পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য জনপ্রতি ভাড়া ছিল প্রতি কিলোমিটারে এক টাকা ৮০ পয়সা। এছাড়া জনপ্রতি সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল ১৮ টাকা। এখন এর সঙ্গে ৬০ শতাংশ যুক্ত হলো।
লঞ্চের সুযোগ-সুবিধার ওপর ভিত্তি করে কেবিনের ভাড়া ডেকের (তৃতীয় শ্রেণি) ভাড়ার চার, তিন, দুই ও দেড়গুণ নির্ধারিত রয়েছে।
এর আগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে লঞ্চে যাত্রী পরিবহনের শর্তে যাত্রী প্রতি ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
গতকাল বুধবার (৩১ মার্চ) সচিবালয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে এক সভার পর বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক স্বাক্ষরিত ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাবের চিঠি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার কথা বলা হয়।
চিঠিতে বলা হয়, ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বুধবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ঈদ প্রস্তুতিসহ যাত্রীবাহী লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি আলোচিত হয়। সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী গণপরিবহনে অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী প্রতিটি লঞ্চের ধারণ ক্ষমতার ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করার নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে লঞ্চ মালিক সমিতি ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। সভায় বিআইডব্লিউটিএ এবং সংশ্লিষ্ট মালিক সমিতির সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিন্ধান্ত অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএ শুধু করোনা ভাইরাস সংক্রমণকালীন অর্থাৎ সরকারি প্রজ্ঞাপনে বর্ণিত সময়ের জন্য লঞ্চের যাত্রীর ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থা/সমিতির সঙ্গে আলোচনা হয়। সভায় লঞ্চের যাত্রী ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে সবা ঐকমত্যে পৌঁছেন।
করোনা সংক্রমণ রোধে গত সোমবার (২৯ মার্চ) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৮ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে বলা হয়, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং ধারণক্ষমতার ৫০ ভাগের অধিক যাত্রী পরিবহন করা যাবে না।
পরে মঙ্গলবার (৩০ মার্চ) ৬০ শতাংশ বাস ভাড়া বাড়িয়ে ধারণক্ষমতার ৫০ ভাগ যাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত বুধবার থেকে কার্যকর করা হয়।
এদিকে গণপরিবহন সংকট এবং সরকারের বাস ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়ক আটকিয়ে বিক্ষোভ করছেন সাধারণ যাত্রীরা।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অফিসগামী যাত্রীরা রাজধানীর খিলক্ষেতে বিমানবন্দর সড়কের দুপাশে অবস্থান নেন। এ সময় সড়কের দুদিকেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বাস থেকে যাত্রীরা সড়কে নেমে এসে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, সকাল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টপেজে দাঁড়িয়ে থেকে বাসে ওঠা যাচ্ছে না। বাসের দরজা বন্ধ। একদিনে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে শতচেষ্টা করেও বাসে সিট পাওয়া যাচ্ছে না। এতে দুর্ভোগের শেষ নেই। এর স্থায়ী সমাধান চাচ্ছেন যাত্রীরা।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সরেজমিন দেখা গেছে, খিলক্ষেত সড়কের দুপাশ বন্ধ। সহস্রাধিক যাত্রী সড়কে অবস্থান নিয়ে আছেন। তাদের বেশিরভাগই অফিসগামী। সড়কের দুপাশে সারি সারি গাড়ি। গাড়িতে থাকা যাত্রীরাও নেমে এসেছেন রাস্তায়। ট্রাফিক পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একজন জানান, বুধবার থেকে এই দুর্ভোগ শুরু হয়েছে। আজকেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বাস পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে অফিসে প্রবেশের সময় চলে যাচ্ছে। এই দুর্ভোগ প্রতিদিন মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান চান তারা।
যাত্রীরা বলেন, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিআরটিএর পক্ষ থেকে জানানো হয় বাসে অর্ধেক সিট খালি রেখে বাস চলাচল করতে হবে। সে কারণে পরিবহনগুলো উত্তরা কিংবা গাজীপুর বাস স্টপেজ থেকে যাত্রী উঠিয়ে বাসের গেট বন্ধ করে অন্য গন্তব্যের দিকে রওনা হয়। এতে করে রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষমান থাকা যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েছে। সব বাস গেট বন্ধ করে চলাচল করছে। আমরা সকাল থেকে অপেক্ষা করেও কোনো বাসেই উঠতে পারছি না। এই কারণেই আমরা রাস্তায় অবরোধে বাধ্য হয়েছি।
এতে পুরো বিমানবন্দর সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ জটলা তৈরি হয়। কুড়িল ফ্লাইওভার-বনানী আর অপরদিকে প্রায় উত্তরা পর্যন্ত সড়ক স্থবির হয়ে পড়ে। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে অবরোধকারীরা সরে গেলেও সড়কে যানবাহনের তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
খিলক্ষেত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্সী ছাব্বীর আম্মদ জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে বাসগুলো অর্ধেক যাত্রীর বেশি তুলছে না। এর ফলে অফিসগামী মানুষরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বাসে উঠতে পারছেন না। এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে খিলক্ষেত ওভার ব্রিজের নিচে রাস্তা বন্ধ করে অবস্থান নেন।
এর মধ্যে পুলিশ বিক্ষুব্ধদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রায় ২০ মিনিট পর বিক্ষুব্ধরা সরে গেলে সড়কে যান চলাচল শুরু হয়।
এদিকে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন পাঠাও, উবারের চালকেরা। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এবং শাহবাগ মোড়ে মোটরসাইকেল নিয়ে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন কয়েক শ চালক।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসে গতকাল বুধবার। এ নিষেধাজ্ঞা আপাতত দুই সপ্তাহের জন্য বা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে।
গতকাল নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর আজ সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মোটরসাইকেলচালকেরা বিক্ষোভ করেন। বেলা পৌনে একটার দিকে শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভ করেন পাঠাও, উবারের চালকেরা।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপ বন্ধের প্রতিবাদে রাজধানী ধানমন্ডি ২৭, বাড্ডা এলাকাতেও মোটরসাইকেল চালকেরা বিক্ষোভ করেছেন। তাদের একটাই দাবি, রাইড শেয়ারিং চালু করা হোক।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া ইমরান নামের একজন বলেন, ‘আমাদের পেটে লাথি মারা হয়েছে। আমাদেরকে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনের সুযোগ দিতে হবে। এই দাবি আদায় করেই আমরা রাস্তা ছাড়ব।’
কিভাবে সবাই একত্রিত হলেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে।’
সোহেল নামের আরেকজন বলেন, ‘বাসে, সিএনজিত যাত্রী পরিবহনে কোনো সমস্যা নেই। সবাই কাজে বের হচ্ছে। শুধু আমাদের ক্ষেত্রে সমস্যা। আমরা আমাদের রুটি-রুজির জন্য রাস্তায় নেমেছি। আমাদের পেটে লাথি মারা হয়েছে। যতক্ষণ মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনের অনুমোদন দেয়া না হবে, তৎক্ষণ আমরা রাস্তা ছাড়ব না।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার করোনা পরিস্থিতিকে ঠিকভাবে সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে যাতায়াত ব্যবস্থায়ও সরকার সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। করোনার মত এমন বৈশ্বিক মহামারিতে সরকার জনগণের ঘাড়েই সবকিছু চাপাচ্ছে। বিদেশফেরতদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে নিজের খরচায় থাকা, বাসে যাত্রী কম উঠবে কিন্তু ভাড়া ৬০ শতাংশ বেশি, লঞ্চেও তাই, সরকার যেন কোনো দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না।
তারা বলেন, সরকার ভর্তুকি দিয়ে যাতায়াত ভাড়া স্বাভাবিক রাখতে পারে। কিন্তু তারা সেটা করবে না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তিতে সরকার কখনো টলেনি, টলবেও না। যাতায়া ও পরিবহন ব্যবস্থার এমন বিশৃঙ্খলার জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবকে দায়ি করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ