ঢাকার পোস্তগোলার সুমন রহমানের স্ত্রীর করোনাভাইরাস ধরা পড়লে গত ২৪ মার্চ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু চারদিন পর চিকিৎসক যখন তাকে আইসিইউতে নিতে বললেন, আর সুমন যখন জানলেন যে ঢাকা মেডিকেলের কোভিড ইউনিটে আইসিইউ শয্যা খালি নেই, তখন তার পানিতে পড়ার দশা।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “সরকারি-বেসরকারি সবগুলো কোভিড হাসপাতালে যোগাযোগ করেছি আমি, কোথাও ফাঁকা পাচ্ছিলাম না। সারা রাত ধরে কমপক্ষে ৫০টা জায়গায় ফোন করেছি। কোথাও আইসিইউ নাই।”
পরে গ্রিনরোডের এক হাসপাতালে একটি আইসিইউ শয্যা পেয়ে স্ত্রীকে দ্রুত সেখানে ভর্তি করান সুমন। এখনও তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন। সুমনের মত এমন সঙ্কটে পড়া মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতালেও শয্যা পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।
এক মাস আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে হাসপাতালগুলোর ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল। বুধবার ( ৩১মার্চ) তা বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি যেখানে আইসিইউর ২৫ দশমিক ২৬ শতাংশ শয্যা পূর্ণ ছিল, ৩১ মার্চ তা বেড়ে হয়েছে ৬৫ শতাংশ।
এ অবস্থায় হাসপাতালে সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার দ্রুত জোরালো পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোগী সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিকে দ্বিতীয় ঢেউ নয়, দ্বিতীয় সুনামির সঙ্গে তুলনা করে চিকিৎসকরা বলছেন, গত বছর ১৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী মারা যাওয়ার পর ঢাকা ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছিল। অথচ এখন যে হারে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে তা নিয়ে কেউ গা করছে না। আগে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের জন্য কাড়াকাড়ি থাকলেও এখন স্বাস্থ্যবিধির প্রতিও মানুষ উদাসীন। তাই মানুষকে বাধ্য করতে হবে। চিকিৎসকরা বলছেন, সংক্রমণ কমিয়ে আনতে আগের চেয়ে কঠোর লকডাউনের বিকল্প নেই।
২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৫২ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এটাও গত সাত মাসে সর্বোচ্চ। এর আগে গতবছরের ২৬ আগস্ট ৫৪ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল অধিদফতর। ৩০ মার্চ মারা গেছেন ৪৫ জন। তার আগের দিনও ৪৫ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল অধিদফতর।
ঢাকায় আইসিইউর জন্য হাহাকার
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি ব্যবস্থাপনার ১০টি হাসপাতালের ১০৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে গতকাল ১০৩টিতে রোগী ভর্তি ছিলেন। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল কোনো আইসিইউ ফাঁকা ছিল না। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১টি এবং রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল এবং মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ২টি আইসিইউ ফাঁকা ছিল।
ঢাকার দুটি সরকারি হাসপাতালের করোনা ইউনিটের চিকিৎসক গণমাধ্যমকে বলেন, আইসিইউ ফাঁকা নেই, কিন্তু আইসিইউর চাহিদা অনেক। অধিকাংশ সময়ই ১৫ থেকে ২০ জন রোগী আইইসিইউর অপেক্ষায় থাকছেন। রোগীর স্বজনেরা রীতিমতো কান্নাকাটি করছেন একটি আইসিইউর জন্য। চিকিৎসকেরা নিরুপায় হয়ে গেছেন। অন্য হাসপাতালে যে পাঠাবে, সেখানেও একই অবস্থা।
ঢাকায় আইসিইউর পাশাপাশি সাধারণ শয্যাতেও রোগীর চাপ বেড়েছে। ঢাকায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ২ হাজার ৫১১টি। এগুলোর মধ্যে ২ হাজার ২৪৬টি শয্যায় রোগী ভর্তি ছিলেন। ফাঁকা ছিল ২৬৫টি শয্যা। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনার জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ২৭৫টি। গতকাল এই হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিলেন ৪২১ জন, অর্থাৎ ধারণক্ষমতার ১৪৬ জন বেশি। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালেও ধারণক্ষমতার চেয়ে ১১ জন করোনা রোগী বেশি ভর্তি ছিলেন।
ঢাকার বাহিরে আইসিইউ
করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৩১ জেলার মধ্যে ১৫টিতেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। ১০ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এত দিনেও জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতিকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত উচ্চ সংক্রমণ রয়েছে এমন ৩১টি জেলার মধ্যে ১১টি জেলা ঢাকা বিভাগে। এক সপ্তাহ ধরে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে, মৃত্যুও এই বিভাগে বেশি। সারা দেশে এক সপ্তাহে মারা যাওয়া ২৪৯ জনের মধ্যে ১৭৮ জনই ঢাকা বিভাগের। অথচ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বিভাগে উচ্চ সংক্রমণ থাকা ১১ জেলার ছয়টিতেই আইসিইউ নেই। জেলাগুলো হলো: টাঙ্গাইল, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, নরসিংদী, রাজবাড়ী ও মুন্সিগঞ্জ। গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রাম বিভাগে মারা গেছেন ৩১ জন। এই বিভাগে উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা নোয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইসিইউ নেই।
উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা খুলনা বিভাগের নড়াইল ও যশোর, রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ ও নাটোর এবং রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলায় আইসিইউ সুবিধা নেই। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে রাজশাহীতে ১৫ জন, খুলনায় ১১ জন ও রংপুর বিভাগে ৩ জন মারা গেছেন।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও এনসিডিসির লাইন ডিরেক্টর রোবেদ আমিন বলেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট করার মতো যন্ত্রপাতি, শয্যার ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিন্তু আইসিইউ পরিচালনা করতে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স প্রয়োজন। জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট করার মতো লোকবলের অভাব রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পরেও জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ করা যায়নি। ১০ মাসে আইসিইউর ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল। করোনা রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একেবারেই মনোযোগ দেয়নি।
করোনার এই ঊর্ধ্বগতিকে সুনামির সঙ্গে তুলনা করে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘করোনা সুনামির তীব্রতায় ছড়াচ্ছে। সামনে মহাদুর্যোগ।’ যে পদক্ষেপগুলো নেওয়ার প্রয়োজন ছিল ১৯ মার্চ, সেগুলো নেওয়া হলো ২৮ মার্চ। ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমরা করোনার গতির চেয়ে ১০ দিন পিছিয়ে আছি।
সরকারি, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ব্যবসায়িক সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ করা, সব মেলা, বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ রাখা। বিয়ে, জন্মদিন স্থগিত করা, রাত নয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত কারফিউ জারি। অনলাইনে অফিস চালানো, বিভিন্ন এলাকাকে রেডজোন ঘোষণা করে লকডাউন করা, স্বাস্থ্য রেড অ্যালার্ট জারি করা, স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠে নামানো এবং স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গকারীকে কঠোর শাস্তি দেওয়া এবং সকল গণপরীক্ষা স্থগিত করা অত্যন্ত জরুরি বলে জানিয়েছেন তিনি।
১৮ দফা নির্দেশনা নতুন কিছু নয়। আগের নির্দেশনাকে ডান-বাম করা হয়েছে মাত্র। এমন মন্তব্য করেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান। যেটা দেখছি সেটা টিপ অব দ্য আইস বার্গ। কারণ জনসংখ্যার অনুপাতে যেখানে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ লাখ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল, সেখানে হচ্ছে মাত্র ২৮ হাজার। প্রকৃত চিত্রটা তাই আড়ালেই রয়ে গেছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১২৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ