সংবিধানে নিশ্চয়তা থাকলেও বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটাই সংকুচিত বলে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ। বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার (৩০মার্চ) প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরাও হয়রানি ও নির্যাতনের ভয়ে সরকারের সমালোচনা থেকে নিজেদের অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই উচ্চকণ্ঠ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তবে তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে সরকার। গতকালই তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম যে স্বাধীনতা ভোগ করে, অনেক উন্নত দেশেও তা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার বিষয়ক এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ থাকলেও সরকার অনেক ক্ষেত্রেই তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং দেশটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার “উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা” রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সাথে তুলনা করা হয়- যার সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন পর্যন্ত হতে পারে। প্রতিবেদন বলছে, আইনে ‘হেইট স্পিচ’ বা ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও একে যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। যার কারণে সরকার একে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করার সুযোগ পায়।
সরকার যদি কোন বক্তব্যকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যায় বা বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কে প্রভাব ফেলে বলে মনে করে, অথবা জনশৃঙ্খলা-নৈতিকতা-শালীনতার পরিপন্থী, বা আদালত অবমাননাকারী বা অপরাধে প্ররোচনাদানকারী বলে মনে করে – তাহলে সরকার মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে ।
এতে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারির সময় সরকার ২০১৮ সালে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে মহামারি মোকাবেলায় সরকারের সমালোচনাকারী ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সরকারের সমালোচনাকারী প্রিন্ট ও অনলাইন গণমাধ্যমকে সরকারের চাপে থাকতে হচ্ছে। আর লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতার কারণে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর ওপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণ কাজ করছে।
গণমাধ্যমের ওপর চাপের আরেক নজির হিসেবে তাদের আয়ের পথ বিজ্ঞাপনে হাত দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, সরকারি বিজ্ঞাপন অংশত বন্ধ এবং বিজ্ঞাপন না দিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে গোয়েন্দা সংস্থার চাপ দেওয়ার অভিযোগ এসেছে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে। যে গণমাধ্যম সমালোচনা করছে, তাদের শাস্তি দিতে বিজ্ঞাপন আটকে দেওয়ার এই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম মুক্তভাবে কাজ করা থেকে অনেকটাই গুটিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের অভিযোগ, সরকার কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার চাপে পড়ার শঙ্কায় তাদের অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ না করে চাপা দিয়ে দিচ্ছেন তাদের প্রতিষ্ঠানের সংবাদ ব্যবস্থাপকেরা।
স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা দিতে ইন্টারনেটে নিয়ন্ত্রণের কথাও উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে। গবেষণার ক্ষেত্রেও কিছু কিছু নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র।
মহামারির নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সরকারের বাধা দেওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমনে সরকার–সমর্থকদের বাধার কথাটিও এতে এসেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ও তার এজেন্টরা এ ধরনের বেআইনি কাজ করছে বলে বহু অভিযোগ রয়েছে।
বিস্তারিত এই প্রতিবেদনটিকে ৭টি মূল সেকশনে ভাগ করা হয়েছে যেখানে গুরুত্ব পেয়েছে নির্যাতন, কারাগারের বৈরী পরিস্থিতি, বেআইনিভাবে আটক, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, সহিংসতা, বেআইনিভাবে সাংবাদিক ও মানবাধিকার-কর্মীদের গ্রেফতার, সেন্সরশিপ আরোপ, সাইট ব্লকিং, শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া ও সংগঠনের অধিকার হরণ, চলাচলের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, নারী ও মেয়েদের বিরৃদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ ও সহিংসতা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি সহিংসতা ও হুমকি, সমকামীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, শ্রমিক সংগঠন ও ইউনিয়নে গঠনে কঠোরতা এবং শিশু শ্রমের মতো বিষয়গুলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনী ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের বিষয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায়মুক্তি দিয়ে থাকে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত ও বিচারের বিষয়ে খুব কম পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।
জুলাইয়ের ৩১ তারিখে কক্সবাজারে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। যেখানে বলা হয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং এর জের ধরে পরবর্তীতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। হত্যার দায়ে ২১ পুলিশ কর্মকর্তা বহিষ্কার এবং নয় জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এখনো নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম এবং অপহরণের মতো ঘটনা হয়। গত বছরের ১০ মার্চ বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ফটো-সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল গুম হন। মে মাসে তার খোঁজ মিললেও তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা করা হয়। মোট ২৩৭ দিন কারাগারে থেকে অবশেষে ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান তিনি।
গত সেপ্টেম্বরে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় প্রথম একটি মামলার রায় দেয় যেখানে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন ও দুই জনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে বলা হয়, ২০১৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এলেও ওই নির্বাচন মুক্ত ও অবাধ ছিল না এবং তাতে অনিয়ম হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন।
আইনে শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার থাকলেও শ্রমিক সংগঠন হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার শর্ত কঠোর বলে উল্লেখ করা হয়। বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নথিভূক্তির শর্তের অপব্যবহার করা হয়। কারণ ছাড়াই বাতিল করা হয় নথিভুক্তির আবেদনও।
রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা ইপিজেড এর প্রায় ৫ লাখ শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আইনের মাধ্যমে খর্ব করা হয়েছে। শ্রমিক কল্যাণ সংস্থাগুলো বেশিরভাগ সময়েই বেপজার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় – যার কারণে স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন সম্ভব হয় না।
এছাড়া শ্রমিকদের আন্দোলন উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে ২৬টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকল বন্ধের বিষয়টিও উঠে আসে। এছাড়া জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যৌন শোষণের মামলা ও অভিযোগের তেমন তদন্ত না হওয়া, ভুক্তভোগীদের পর্যাপ্ত সরকারি সহযোগিতা ও নিরাপত্তা না দেয়ার মতো অভিযোগ তুলে ধরা হয়।
তৈরি পোশাক ও চিংড়ি শিল্প ছাড়া সব সেক্টরেই শিশু শ্রম রয়েছে বলে জানানো হয়। সেই সাথে মজুরী বৈষম্য, গ্রহণযোগ্য কর্ম-পরিবেশের বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৮৪০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ