মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানে ভারতভিত্তিক বহুজাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপ সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী ও আইনজীবীদের কাছ থেকে ফাঁস হয়ে যাওয়া কয়েকটি নথিপত্রের ওপর ভিত্তি করে বার্তা সংস্থা এবিসি নিউজের তৈরীকৃত প্রতিবেদন থেকে এমনটা জানা যায়। অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস (এসিআইজে) এবং জাস্টিস ফর মিয়ানমার (জেএফএম) নামে দুটি সংগঠন বলছে, নথিপত্রে এমইসি’কে বিপুল অর্থ দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে তারা। এদিকে মিয়ানমার জান্তা সরকারের উপরে আরোপ করা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আঁচ হয়তো পৌঁছে যাবে ভারতের ঘরেও।
সেনা অভ্যুত্থানে আদানি গ্রুপের সম্পৃক্ততা
সূত্র মতে, আদানি গ্রুপ ইয়াঙ্গুনে একটি কন্টেইনার পোর্ট (জাহাজের কন্টেইনার জমা রাখার জন্য সমুদ্র-বন্দর) তৈরি করতে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করেছে।
প্রতিবেদনের বিভিন্ন ভিডিও ও স্থিরচিত্রে দেখা যায় আদানি পোর্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) করন আদানি মিয়ানমারের উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা জেনারেল মিন আং হ্যালেইংয়ের সাথে বৈঠক করছেন।
মিয়ানমারের এ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ জেনারেলের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরেই তার সাথে করন আদানি এ বৈঠক করেন।
এ ঘটনা আদানি গ্রুপের একটি বক্তব্যের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। ওই বক্তব্যে আদানি গ্রুপ বলেছে, তারা মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বে সাথে জড়িত নয়।
আদানি গ্রুপ শুধুমাত্র জমি লিজ (ইজারা) নেবার জন্য সম্পূরকভাবে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করেছে মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশনকে। সম্প্রতি মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশনকে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে।
৩১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান
অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টান্যাশনাল জাস্টিস ও জাস্টিস ফর মিয়ানমার নামের দুই মানবাধিকার সংগঠনের যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়া হয়েছে মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশনকে জমির ছাড়পত্র ফি হিসাবে। এর মাধ্যমে আদানি গ্রুপ ইয়াঙ্গুন সমুদ্র-বন্দরের জমির মালিক হয়।
মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন মূলত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এবং তারাই এ প্রতিষ্ঠানের মালিক।
মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন (এমইসি) ও মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিং লিমিটেডের (এমইএইচএল) ব্যবসার মুনাফা যে সরাসরি সেনা অভিযানে ব্যবহার করা হয়েছে, জাতিসংঘ তার প্রমাণ পেয়েছে।
এ সামরিক বাহিনী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও ইন্টান্যাশনার কোর্ট অব জাস্টিস আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যাসহ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে তদন্তও চলছে।
এ প্রতিবেদনটি ১ ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের কিছু দিন পরে প্রকাশিত হয়। আর এ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন জেনারেল মিন আং হ্যালেইং।
এছাড়া, প্রতিবেদনে দেখা গেছে আদানি গ্রুপ তাদের মিয়ানমার বন্দর প্রকল্পে ১৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সরাসরি প্রদান করেছে। আর বন্দরটির মালিকানা পাবার জন্য দিয়েছে ১৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মাধ্যমে মূলত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর আর্থিক সক্ষমতাই বেড়েছে।
পরিস্থিতি জেনেই সম্পর্কে আদানি গ্রুপ
মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠান বার্মিজ সেনাদের সরাসরি অর্থ সরবারহ করে। এ বিষয়টি ২০১৯ সালে জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দলের তদন্তেও প্রকাশ পেয়েছে। আর আদানি গ্রুপ মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশনের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করতে চায় না।
যদিও আদানি গ্রুপকে অনেকবার সতর্ক করা হয়েছে। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের একটি সত্য-অনুসন্ধানী মিশন মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশনের সঙ্গে ব্যবসায়িক কার্যক্রম রাখার বিষয়ে বেশ কিছু বিদেশি সংস্থাকে সতর্ক করেছিল। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ভারতের এই আদানি গ্রুপ।
এর ফলে এ ব্যাপারটা প্রমানিত হয় যে আদানি গ্রুপ পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে অর্থ দিচ্ছে যাতে তারা সামরিক অভ্যুত্থান করতে পারে।
এমনকি গুজরাটের মুন্দ্রার আদানি পোর্টে করন আদানি ও জেনারেল মিন আং হ্যালেইং পরস্পরের মধ্যে উপহার বিনিময় করছেন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে এ তথ্য দেখা গেছে।
আদানি গ্রুপের মুখপাত্র বলেছেন, মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক টার্মিনাল প্রকল্প পুরোপুরি স্বতন্ত্র, এতে তাদের সাথে আর কারো অংশীদারিত্ব নেই।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অপকর্ম সম্পর্কে সবাই জানে এমনকি আদানি গ্রুপও জানে । তবুও আদানি গ্রুপও মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশনে অর্থ ঢালছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আঁচে পুড়তে পারে ভারত
যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি মিয়ানমার জান্তা সরকারের অর্থ সরবরাহ কমাতে সেনানিয়ন্ত্রিত দুটি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখন থেকে সংস্থা দুটির সঙ্গে কেউ কোনও ধরনের বাণিজ্যিক বা আর্থিক সম্পর্ক রাখলে তার ওপরও নেমে আসতে পারে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার খড়গ। আর সেই বিপদে ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মিয়ানমারে জান্তা সরকারের অন্যতম প্রধান আয়ের উৎস বলা হচ্ছে মায়ানমা ইকোনমিক পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড এবং মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন (এমইসি) নামে দুটি সংস্থাকে। গত সপ্তাহে সেনানিয়ন্ত্রিত সংস্থা দুটির ওপর ব্যবসায়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগ।
মঙ্গলবার ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদন অনুসারে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আঁচে পুড়তে চলেছে আদানি গ্রুপও। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার একদল আইনজীবী দাবি করেছেন, আদানি গ্রুপের সঙ্গে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশনের আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে। তাদের অভিযোগ, আদানি গ্রুপ এমইসি’কে আড়াই হাজার কোটি রুপি দিচ্ছে।
চীন বা ভারতের মতো দেশগুলোর বিপুল পরিমাণে বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে বলেই রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রশ্নে তারা সেভাবে মিয়ানমারের সমালোচনা করে না।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল কয়লা খনি সংশ্লিষ্ট একটি বন্দর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে আদানি গ্রুপের অঙ্গসংস্থা আদানি পোর্টস। তাদের সঙ্গে লেনদেন বন্ধে ক্যানবেরার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এসিআইজে।।
তবে আদানি গ্রুপের চোখে বিষয়টি অন্যরকম। আদানি পোর্টসের এক মুখপাত্র বলেছেন, মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক টার্মিনাল প্রকল্প পুরোপুরি স্বতন্ত্র, এতে তাদের সঙ্গে আর কারও অংশীদারিত্ব নেই। এছাড়া আদানি পোর্টস মিয়ানমারের পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে আগামীতে ব্যবস্থা নেবে।
এর আগে, বন্দরের অনুমতির জন্য মিয়ানমার জেনারেলদের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ অস্বীকার করেছিল আদানি গ্রুপ।
রোহিঙ্গা গণহত্যায়ও ব্যবসায়িক অংশিদার
রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানোয় অভিযুক্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অধীনস্থ সংস্থার সঙ্গে ব্যবসা করেছে আদানি শিল্পগোষ্ঠীসহ ভারতের একাধিক কোম্পানি।
সূত্র মতে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এসব সংস্থা জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্টে অভিযুক্ত হওয়ার পরও তাদের সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানি ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছে।
এই কোম্পানিগুলো নৈতিকতার সঙ্গে আপস করেই মিয়ানমারে ব্যবসা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক তোয়ে তোয়ে থেইন। এদের মধ্যে ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠী বা ইনফোসিসের মতো টেক সংস্থাও রয়েছে বলেও তিনি জানান।
চীন বা ভারতের মতো দেশগুলোর বিপুল পরিমাণে বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে বলেই রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রশ্নে তারা সেভাবে মিয়ানমারের সমালোচনা করে না। বিষয়টি গত কয়েক বছর ধরেই আলোচনায় আসছে।
অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক গবেষক ও অধ্যাপক তোয়ে থেইনের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টেও সেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
অধ্যাপক তোয়ে বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এই প্রথমবারের মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানির সমালোচনা করা হয়েছে- যারা মিয়ানমারের সেনার সঙ্গে অংশীদারত্বে সে দেশে ব্যবসা চালাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার আর্মির অধীন দুটি সংস্থা, মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন (এমইসি) ও মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিং লিমিটেডের (এমইএইচএল) ব্যবসার মুনাফা যে সরাসরি সেনা অভিযানে ব্যবহার করা হয়েছে, জাতিসংঘ তারও প্রমাণ পেয়েছে। সে কারণেই জাতিসংঘ এই সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে এই কোম্পানিগুলোকে আহ্বান জানান।’
নরেন্দ্র মোদির প্রশ্রয়ে ভারতীয় এই ধনকুবের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে ক্রমাগত উৎসাহ পাচ্ছে আদানির উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা। দুই দশক ধরে কয়লাকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গড়ার পর গৌতম আদানি এবার জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়িয়ে নিজের শিল্প গ্রুপের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করছেন। খনি, বন্দর এবং পাওয়ার প্লান্ট থেকে শুরু করে বিমানবন্দর, ডাটা সেন্টার এবং প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বিস্তৃত করে ভারতের অবকাঠামো বাদশাহ হিসেবে উঠে এসেছেন আদানি।
দেশটির অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে এসব খাতকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন নরেন্দ্র মোদি। আর সরকারের লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন এসব খাতের বিনিয়োগকারীরা।
গত বছর মহামারির মধ্যে আদানি গ্রুপের তালিকাভুক্ত ছয়টি ইউনিটের বাজারমূল্য বেড়েছে সাত হাজার নয়শ’ কোটি ডলার। ভারতের দুই শীর্ষ বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য টাটা গ্রুপ এবং মুকেশ আম্বানির নেতৃত্বাধীন রিলায়েন্স গ্রুপের পর এটাই সবচেয়ে বড় সম্পদ বৃদ্ধির ঘটনা। আদানির কোম্পানিতে অর্থ বিনিয়োগ করেছে ফ্রান্সের তেল কোম্পানি টোটাল এসই এবং ওয়ারবার্গ পিনাকস এলএলসি।
১৯৮০’র দশকের শেষ দিকে নিত্যপণ্য দিয়ে ব্যবসায় আসেন আদানি। কিন্তু এখন তিনি জ্যাক মা’র চেয়েও বেশি ধনী এবং ভারতের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনকুবের। তার মোট সম্পদের পরিমাণ পাঁচ হাজার ছয়শ’ কোটি ডলার। গত এক বছরেই তিনি অর্জন করেছেন পাঁচ হাজার কোটি ডলার। যা এশিয়ার শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানির থেকেও পাঁচশ’ কোটি ডলার বেশি। এই বছর আদানির সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ অন্য যে কোনও ধনকুবের থেকেই বেশি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮১২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ