বিশেষ প্রতিবেদক : যতো দিন বদলাচ্ছে, ততোটাই বদলে যাচ্ছে ক্যারিয়ার আর ব্যবসার ধারণা। প্রথাগত অর্থনীতিতে বাজার বলতে যে ক্রেতা, বিক্রেতা ও স্থান বোঝায় তা অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। বাজার একটি স্থান, এই ধারণা বদলাতে বদলাতে এ দশকে এসে যুক্ত করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আরও পরিস্কার করে বললে, মার্ক জুকারবার্গ সেই ম্যাজিশিয়ান, যার জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় বদলে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের সামগ্রিক চালচিত্র। তরুণদের কর্মসংস্থানের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এফ-কমার্স বা ফেইসবুক ব্যবসা। ২০১৯ সালে অন্য সব কিছুর মতো এগিয়ে গিয়েছে এই এফ-কমার্সও।
আমাদের দেশেও ফেসবুকনির্ভর বাণিজ্যে (এফ-কমার্সে) যুক্ত আছে অসংখ্য তরুণ-তরুণী। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কেবল এই খাতের পেমেন্ট গেটওয়ে, কুরিয়ার সার্ভিস, কল সেন্টার, ব্যাংকিং ও পাইকারি ব্যবসার সঙ্গে প্রায় এক লাখ মানুষ জড়িত। এদিকে গত শনিবার (২৭ মার্চ) থেকেই সারাদেশে বিঘ্নিত হয়ে আসছে ফেসবুক। ব্যবহারকারীরা হয় একেবারেই ফেসবুক ব্যবহার করতে পারছেন না আর নয়তো ধীর গতিতে এটি ব্যবহার করতে হচ্ছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতৃত্বে কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন আন্দোলন-হরতালের মতো কর্মসূচি দিলে ফেসবুকের ব্যবহার সীমিত করে সরকার। এরকম অবস্থায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও অনলাইন-ভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।
এদিকে, চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর হচ্ছে এফ-কমার্সের সাথে জড়িত উদ্যোক্তাদের। ফেসবুক সরকারের কোনো কথা শোনে না উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটিকে ‘গোঁয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। সবার আগে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। এর জন্য প্রয়োজনে ফেসবুকের বিরুদ্ধে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলেও আভাস দিয়েছেন মোস্তাফা জব্বার।
ক্ষতির মুখে এফ কমার্স
ফেসবুক ব্যবহার সীমিত থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসায়ীরা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী উদ্যোক্তারাও রয়েছেন। আবার বিভিন্ন ফেসবুক পেজের অ্যাডমিনরা বলছেন, সীমিত ফেসবুকের এ সময়ে তাদের অনেকেরই ‘মনিটাইজিং’ অনুমতি বাতিল করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি। অনেকেই আবার তাদের ফেসবুক বিজনেস অ্যাকাউন্টে থাকা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অর্থের ব্যালেন্স ‘শূন্য’ দেখছেন।
শারমিনা ইসলাম নামে এক নারী উদ্যোক্তা বলেন, আমাদের সেল বেশি হয় ফেসবুক থেকেই। সামনে ঈদকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার (২৬ মার্চ) ফেসবুকে কিছু পোস্ট বুস্ট এর জন্য দিয়েছিলাম। প্রায় ১০০ ডলারের মতো। কিন্তু শনিবার থেকেই ফেসবুক ডাউন। প্রচারের জন্য আমার এ বিনিয়োগ একদম বিফলে গেল। ফেসবুক ঠিকই টাকা কেটে নিচ্ছে কিন্তু কোনো অর্ডার আসছে না।
এসব বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। ফেসবুক তার আগের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলছে, বাংলাদেশে আমাদের একাধিক সেবা সীমিত করার বিষয়টি আমরা জানি। আমরা এটি বোঝার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি, দ্রুতই পূর্ণাঙ্গ সেবা পুনরায় সচল হবে।
বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণে ফেসবুককে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অনুরোধ করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমরা কিছু বললেই কী তারা শুনবে? তাদের গোয়ার্তুমির তো শেষ নেই। তারা সরকারের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা করে না। আজকেও একটা প্রতিবেদন পেয়েছি যে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের কোনো পোস্ট এলে তারা সেটি সরিয়ে ফেলে। কিন্তু বিপক্ষের কোনো পোস্ট এলে সেটি রাখে। এভাবে তো হবে না। রেডিকালাইজেশনের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠছে ফেসবুক অনেকের কাছে। এক্ষেত্রে ফেসবুককে আরও কঠোরতার মধ্যে আনার কথা ভাবছি আমরা।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে
‘ফেসবুক ব্যবহার বন্ধের কারণে ক্ষুদ্র এফ-কমার্স উদ্যোক্তাদের পথে বসার অবস্থা। অনলাইনে অর্ডার করা পণ্য আমরা ক্রেতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিই। ফেসবুক বন্ধের পর আমাদের ই-কমার্স পণ্যের ডেলিভারি ৭০ শতাংশ কমে গেছে। ছোট উদ্যোক্তারা বড় ধরনের সংকটে আছি’, ফেসবুক বন্ধের প্রভাব এভাবেই ব্যাখ্যা করেন ই-কমার্স পণ্যের অর্ডার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ই-কুরিয়ারের প্রধান নির্বাহী বিপ্লব ঘোষ রাহুল।
তিনি বলেন, ‘ফেসবুক বন্ধের আগে প্রতিদিন এক হাজারেরও বেশি পণ্য গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতাম। কিন্তু শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠানে এখন অর্ডার ৭০ শতাংশ কমে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে।’
দেশে বাগডুমডটকম, দারাজডটকম, আজকেরডিল, এখুনিডটকম, আপনজোন, কেইমুডটকম, প্রিয়শপ, ইউনিকবিডি, বিক্রয়ডটকম, ক্লিকবিডিসহ এক হাজারের বেশি ই-কমার্স ও মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান আছে। এ ছাড়া এফ-কমার্সে অঙ্গনা, অপ্সরা, আইগ্যাজেট শপবিডি, গ্যাজেট বাংলাদেশ, ই-পণ্য, গিফটশপবিডিসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আছে যারা মূলত ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচারণা চালায়।
ফেসবুকের অভাবে এসব উদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে দেশের অন্যতম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বাগডুমডটকমের (সাবেক এখনিডটকম) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা কামরুন আহমেদ জানান, ‘ফেসবুক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটিং টুল। কিন্তু এই সামাজিক মাধ্যম বন্ধের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন প্রচারণা। আমাদের আয়ের ৩০ শতাংশ আসে ফেসবুকনির্ভর বিভিন্ন পণ্য ও সেবা থেকে।’
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সেক্রেটারি জেনারেল উত্তম কুমার পাল জানান, ‘বেসিস সদস্যভুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর লেনদেনের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু আমাদের সদস্য নয়, এমন বহু ক্ষুদ্র ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মূলত ফেসবুক নির্ভর। তারা বিপদে পড়েছে। আশা করছি, সরকার দ্রুত সামাজিক মাধ্যমগুলো উন্মুক্ত করে দেবে।’
তিনি ফেসবুকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরি এবং অন্যান্য বিকল্প ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
পরিধি বাড়ছে এফ কমার্সের
ফেসবুকের এই ব্যবসার ধারণা মূলত ২০১২ থেকে। যদি গত চার বছরের উপাত্ত বিবেচনা করা যায়, কিছু উদ্যোগ ৪০ গুণ বড় হয়েছে, কেউ কেউ ১০ গুণ পর্যন্ত বড় হয়েছে। তবে অন্য সব ব্যবসার মতো এখানেও টিকে থাকা একটা বিষয়, ফলে উদ্যোগগুলোর ঝরে যাওয়ার হারও কম নয়।
এফ-কমার্স কত বড় হয়েছে, এর কোনো সঠিক তথ্য নেই। তবে ২০১৫ সালে যখন প্রথম এফ–কমার্স সামিট হয়, মাসে ২০ হাজার টাকার মতো আয় করতে পারলে ব্যবসাটা চলছে এমন বলা হতো। ২০১৯-এ তৃতীয় এফ-কমার্স সামিটে এসে দেখা গেছে, যে ব্যবসাগুলো চলছে সেগুলো মাসে গড়ে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আয় করছে। এ থেকে বোঝা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অর্থনীতি বড় হয়েছে।
২০১২ সালে লা মোড নামে একটি জুতার উদ্যোগ ফেসবুক থেকে শুরু করেছিলেন জুতার ডিজাইনার ফাহমিদা ইসলাম। ২০১৯ পর্যন্ত ফাহমিদার এখন চারটা শোরুম ও একটি ওয়েবসাইট আছে। ফাহমিদার জুতা বিক্রি হচ্ছে আমাজনেও। ফাহমিদা বলেন, এত কিছু পরেও ফেসবুকে আমাদের অর্ডার আসে এবং আমরাও পণ্যের প্রচারের জন্য ফেসবুকের ওপরেই আস্থা রাখি বেশি।
আইডিএলসি মান্থলি বিজনেস রিভিউতে (ফেব্রুয়ারি ২০১৯) প্রকাশিত ইমার্জেন্স অব এফ-কমার্স স্টার্টআপস প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু ঢাকাতেই নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২২ মিলিয়ন। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারী ৮৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। দেশে এফ-কমার্স মার্কেটের আকার প্রায় ৩১২ কোটি টাকা। ব্যবহারকারীর মধ্যে ৭২ শতাংশের বেশি পুরুষ থাকলেও নারীদের মালিকানায় রয়েছে ৫০ শতাংশ ফেসবুক স্টোর। তাদের মাসিক আয়ের পরিমাণ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা।
কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে তিন লাখেরও বেশি অনলাইন স্টোর ছিল, যা ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ই-ক্যাবের তালিকায় ছিল মাত্র ১০০টি অনলাইন স্টোর। বর্তমানে ই-ক্যাবের তালিকাভুক্ত ওয়েবসাইটের সংখ্যা ৫০০ এবং ফেসবুক কোম্পানির সংখ্যা ২ হাজার।
প্রতি বছরই বাড়ছে এফ-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংখ্যা। এফ-কমার্সের একটি ফেসবুক প্লাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম বা ‘উই’-এর সদস্য সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।
বাংলাদেশে এফ কমার্স জনপ্রিয় কেন?
বাংলাদেশের ৯৩% সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী ফেসবুক ব্যবহার করেন। তারমানে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর একটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে যা এফ-কমার্স পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সোশ্যাল মিডিয়া মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক ব্যবহার করা বেশ সহজ।
নতুন উদ্যোক্তাদের পণ্য প্রচারের জন্য ফেসবুক একটি আদর্শ মাধ্যম যাতে প্রায় বিনা খরচ এই পণ্যের প্রসার করা যায়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যাদের ব্যবসায়িক পুঁজি কম তাদের জন্য ফেসবুক একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম। স্বল্প সময়ে ইন্টারনেট পরিষেবা বৃদ্ধি হওয়াতে ফেসবুকের প্রচার অনেক বেড়েছে। দেশের বেশিরভাগ মহিলা উদ্যোক্তাদের প্রচার এর প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক অথবা এফ-কমার্স
ফেসবুকের মাধ্যমে একটি আদর্শ গ্রাহক সমাবেশ করানো যায়। যার কাছ থেকে আপনি সঠিক সেবাটি পেয়েছেন, আপনি তার পণ্যকে গ্রহণ করেন এবং তার পণ্যের প্রচারে সহায়তা করেন।
বাংলাদেশের প্রায় ৩ লক্ষাধিক ফেসবুক পেইজ আছে। গড়ে ফেসবুক পেইজ থেকে উদ্যোক্তাদের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকা থেকে এক লক্ষাধিক টাকা। বেশিরভাগ ফেসবুক পেজ ব্যবহারকারীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ এর মধ্যে। শুধুমাত্র ঢাকাতেই প্রায় কোটি ২০ লক্ষ সচল ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন। বাংলাদেশ ফেইসবুক এ দেশীয় ব্যবসায়িক বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩১২ কোটি টাকা। এফগকমার্স সুবিধা গ্রহণকারীর মধ্যে ৭২ পার্সেন্ট পুরুষ। ৫০ পার্সেন্ট ফেসবুক পেইজের উদ্যোক্তা নারী জনগোষ্ঠী।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৩৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ