অর্থনীতি ডেস্ক : অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। বুধবার (৪ নভেম্বর সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভা শেষে ভার্চুয়াল মাধ্যমে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আশা করি, আগামী ১৪ মাসের মধ্যে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
উপস্থিত সাংবাদিকরা রিজার্ভের অর্থ দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহার করা হবে কী না জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ভালো প্রজেক্টে সরকার স্পন্সর হিসেবে থাকতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এ ধরনের প্রজেক্টে অর্থায়ন করলে একদিকে আমাদের ঋণ বাড়লো না, আরেকদিকে আমাদের টাকাটা নিজের ঘরেই রয়ে গেল।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস প্রাদুভার্বের পরে বিশ্বব্যাপী অর্থের চাহিদা কমে গেছে। ফলে এখন কোনো বিদেশি ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখা তেমন লাভের অবস্থানে নেই।’
উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর জন্য ঋণ নেয়ার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আদেশ জারি করেছেন। রিজার্ভে যে সাময়িক স্ফীতি পরিদৃষ্ট হয়েছে, সেটা প্রধানমন্ত্রীকে রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজে ব্যয়ের ব্যাপারে প্রলুব্ধ করেছে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত। বিদেশি মুদ্রার রির্জাভ এর বিষয়ে অনেকের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা, মোটামুটি তিন মাসের আমদানি বিল পরিশোধ করার মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট, এর বেশি রিজার্ভের প্রয়োজন নেই। কিন্তু অনেক অর্থনীতিবিদের এই ধারণায় ঘোর আপত্তি আছে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, বৈশ্বয়িক অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়ে এখনই রিজার্ভে হাত দেওয়া উচিত হবে না। রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেগবান করার চিন্তাকে এখনো সময়োপযোগী বলা যাচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন।
তবে অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ এর মতে,দীর্ঘমেয়াদে রিজার্ভ থেকে গেলে, অন্যান্য কাজে লাগানো না গেলে, তখন বুঝতে হবে আমদানি কমে গেছে, অর্থাৎ মানুষের ভোগের পরিমাণ কমে গেছে। তার মানে আমদানির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, ”বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালের আমদানি কমে গেছে কিনা, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ সেটা হলে অর্থনীতির ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়।”
নাজনীন আহমেদ মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জমে থাকা মানে আমদানির প্রবৃদ্ধি কম থাকা মানে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি আশানুরূপ হচ্ছে না ।
চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ থেকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যে রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ইউরোর (এক হাজার ৮৩২ কোটি টাকা) একটি তহবিল গঠন করে সার্কুলার জারি করেছিল। সার্কুলার অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিদ্যমান ইউরো ইন্টার ব্যাংক অফার রেট (ইউরিবর) + ১ শতাংশ সুদে এ তহবিলের অর্থ নিতে পারবে। গ্রাহক পর্যায়ে এ ঋণের সুদের হার হবে বিদ্যমান ইউরিবর + ৩ শতাংশ। যদি ইউরিবর ঋণাত্মক হয়, তাহলে সেটিকে শূন্য ধরা হবে।
উপস্থিত সাংবাদিকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়ার সরকারের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে মুস্তফা কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে পরিকল্পিতভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন। বৈদেশিক রিজার্ভ ব্যবস্থাপনাকে তার চিন্তাভাবনার ফল উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী জানান, ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৬ বিলিয়ন ডলার, তারপরে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে এবং সবশেষ ৪১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
উল্লেখ্য যে সীমাহীন অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকই খেলাপি ঋণ হিসাবে তালিকভুক্ত হয়েছে। এসব খেলাপি ঋণ ফিরে পাওয়ার আশা রাষ্ট্রত্ব ব্যাংকগুলো করছে না। ঋণ খেলাপি এসব সুযোগসন্ধানীদের এখন দৃষ্টি পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিকে। অর্থাৎ, তাদের নতুন লক্ষ্যস্থল এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দ্য ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, রিজার্ভ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য প্রথম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওরিয়ন গ্রুপ তৎপরতা শুরু করেছে। রিজার্ভ থেকে টাকা নিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য গত ২৬ জুলাই থেকে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানিটি ঋণ চায় ৯০৬ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার। টাকার অঙ্কে হিসাব করলে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্টভাবে কোনো একটি ব্যাংক থেকে এক সঙ্গে এতো টাকা ঋণ পাওয়ার নজির নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের অনুমোদন দেওয়া উচিৎ নয়।’ তার মতে, বিষয়টি সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক উভয়কে খুব গুরুত্বসহকারে দেখা উচিৎ।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের মতে, ‘রিজার্ভ থেকে এভাবে টাকা নিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা ফৌজদারি অপরাধের সামিল।’ তিনি মনে করেন, ‘এই ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশ দূষণের অন্যতম নিয়ামক।’
‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অন্যতম নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাধারণত, কোনো দেশের অর্থনীতি যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লেনদেন করতে সঙ্কটে পড়ে তখনই রিজার্ভে হাত দেওয়া হয়,’ বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই অধ্যাপক।
এশিয়ার মাত্র কয়েকটি ধনী রাষ্ট্র ইতোপূর্বে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ব্যবহার করেছে। চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরবসহ হাতে গোণা কয়েকটি দেশ তাদের রিজার্ভের উদ্বৃত্ত অংশ বিনিয়োগ করেছে। অধিকাংশ টাকাই তারা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করেছে অন্যান্য দেশে। কিন্তু, বাংলাদেশের মতো নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর রিজার্ভ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই ধরনের উদাহরণ বিরল।
বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা, ওরিয়ন গ্রুপ’কে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ঋণ দেওয়া হলে অন্যান্য ব্যবসায়ী গ্রুপও ঋণের জন্য আবেদন করবেন। রাষ্ট্রত্ব ব্যাংকের ঋণ খেলাপিরা নতুনভাবে লুটপাটের একটি জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কেন্দ্রিয় ব্যাংকের রিজার্ভের প্রতি দৃষ্টি পড়েছে বেশ কয়েকটি বড় গ্রুপের। যাদের সাথে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এই ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো সরকারী পর্যায়ে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বেসরকারীখাতে ঋণ নীতিগতভাবে অনুমোদনের জন্য দেশি বিদেশি লবিষ্ট নিয়োগ করেছে।
কেন্দ্রিয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বেসরকারীখাতে ঋণ দেওয়ার সরকারী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে বারবার রিজার্ভের বর্তমান স্থিতি এবং ভবিষ্যতে রিজার্ভের স্থিতি কেমন হতে পারে তা জানানো হচ্ছে। রাষ্ট্রয়ত্ব ও বেসরকারী ব্যাংকগুলোর বড় আকারের ঋণ খেলাপিদের রিজার্ভ থেকে ঋণ দিলে তা ফেরত পাওয়ার সম্ভবনা কতটুকু সেটা খতিয়ে না দেখে ঋণ দেওয়ার মত বোকামী সরকার করবে না বলে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৮ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার, জুলাইয়ে ৩৭ বিলিয়ন ডলার, জুনে ৩৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার, মে-তে ৩৩ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার, এপ্রিলে ৩২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার এবং জুনে ৩২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার।
রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছাড়াও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা এবং এআইআইবির থেকে পাওয়া ঋণ সহায়তারও ভূমিকা রয়েছে।
We chose a different approach. Will you support it? We believe everyone deserves to read quality, independent, factual news and authoritative, calm analysis – that’s why we keep State Watch journalism open to all. The free press has never been so vital. No one sets our agenda, or edits our editor, so we can keep providing independent reporting each and every day. Every contribution, however big or small, is so valuable for our future – in times of crisis and beyond. Support the State Watch today a little amount. Thank you.
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ