সবচেয়ে ভয়াবহ রক্তাক্ত দিন দেখল মিয়ানমার। প্রতিবাদকারীদের মাথা ও বুকে গুলির হুমকি উপেক্ষা করে গত শনিবার সারাদেশে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ হয়। এসব বিক্ষোভ দমনের নামে নির্বিচারে গুলি চালায় সেনা নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা বাহিনী। দেশজুড়ে জান্তা নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ১১৪ বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ওইদিনই মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত জমকালো পার্টিতে আনন্দে মেতেছিলেন দেশটির জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং ও ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতিরোধের ৭৬তম বার্ষিকী ছিল গত শনিবার (২৭ মার্চ)।
এ দিন কোনো ধরনের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ না করার জন্য দেশটির সামরিক সরকার নির্দেশনা জারি করেছিল। কিন্তু সেদিন মিয়ানমারজুড়েই ব্যাপক বিক্ষোভ হয় এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশ নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে। এ দিনে ১১৪ জন বিক্ষোভকারী নিহত হন।
রয়টার্সের খবরে জানা যায়, বাগো শহরে নিহত বিক্ষোভকারীদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেও নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে নিরাপত্তাবাহিনী। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী এক নারী জানান, নিরাপত্তাবাহিনী ওই অনুষ্ঠানে ঢুকেই গুলি চালায়।
শনিবার নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে ৪০ জন, দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে ২৭ জনসহ মিয়ানমারজুড়ে অন্তত ১১৪ জনের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার নাও। দেশটিতে গত ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর শুরু হওয়া টানা বিক্ষোভে ওইদিনই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে ওইদিনই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের পর সন্ধ্যায় জমালো পার্টির আয়োজন করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। পার্টিতে আনন্দে মেতেছিলেন দেশটির জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং ও ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা।
দিনটিতে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে মিয়ানমারে কর্মরত সব দেশের মিশনের প্রতিনিধিরা আমন্ত্রিত হলেও মাত্র আটটি দেশের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন। এই আটটি দেশ হলো চীন, রাশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, লাওস ও থাইল্যান্ড। অন্য সব দেশের কূটনীতিকেরা সেনাবাহিনীর ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। বিবিসি, আল-জাজিরাসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনগুলোতে সামরিক জান্তার প্রতি এই উদারতা দেখানোর বিষয়টি তুলে ধরে দেশগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিয়ানমারের সরকারি টিভির শেয়ার করা ছবিতে দেখা গেছে, মিন অং হ্লাইং সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরে আছেন। গলায় টাই বাঁধা। লালগালিচায় তাকে হাঁটতে দেখা গেছে। তার মুখে ছিল হাসি। নৈশভোজের জন্য সবার সঙ্গে বড় একটি টেবিলে বসেছিলেন তিনি।
সেনাবাহিনীর এই জমকালো পার্টির ছবিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। টুইটার ব্যবহারকারীদের অনেকেই সেনাবাহিনীর গুলিতে হতাহত ব্যক্তিদের ছবির পাশে জমকালো ওই পার্টির ছবি দিয়ে টুইট করেন। এই পার্টির আগে সেনাবাহিনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে মিং অং হ্লাইং ‘গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে চান’ বলে বক্তব্য দেন। সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের সতর্ক করেন।
মিয়ানমারে আটক অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি, এনএলডির এমপিদের প্রতিনিধিত্বকারী কমিটি রিপ্রেজেনটেটিভ পিদাংশু হ্লাত্তোর ( সিআরপিএইচ) একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘যখন নিরীহ লোকজনকে হত্যা করা হচ্ছে, তখন (সেনাপ্রধান) মিন অং হ্লাইং এবং তার সহযোগীদের পাশে কয়েকজন কূটনীতিককে দেখে মিয়ানমারের জনগণ কতটা দুঃখ পেয়েছে, তা বর্ণনা করতে আমি অক্ষম।’
বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, যেসব বিদেশি কূটনীতিক সশস্ত্র বাহিনী দিবসের আয়োজনে অংশ নিয়েছেন, তারা নিজেদের দেশের মানুষ, তাদের সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য লজ্জা।
জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব কুল চন্দ্র গৌতম টুইটারে লিখেছেন, ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দেশটির অভ্যুত্থানকে বৈধতা দেওয়া রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, লাওস ও থাইল্যান্ডের কূটনীতিকদের ধিক্কার জানাই।’
মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকারীদের জোট সিভিএমের টুইটেও এ ঘটনার নিন্দা জানানো হয়েছে। জাস্টিস ফর উইমেনের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াই ওয়াই নুন আটটি দেশের নামসংবলিত খবরের ছবি টুইট করে লিখেছেন, ‘এসব দেশ আমাদের হত্যাকাণ্ডের সহযোগী।’ রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকেও অনেকে টুইটে একই ধরনের হতাশা প্রকাশ করেছেন।
মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধির যোগ দেওয়ার বিষয়ে ঢাকায় যোগাযোগ করে সরকারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে মিয়ানমারে সামরিক জান্তাবিরোধী আন্দোলনে যে দিন সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভকারীর মৃত্যু ঘটেছে, সেই দিন নেপিডোতে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশের অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ ঘটনায় শুধু মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামীরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছেন তা-ই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানবাধিকারকর্মী এবং গণতন্ত্রপন্থীরাও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশসহ আটটি দেশের অংশগ্রহণের ঘটনায় সমালোচনা চলছে।
মিয়ানমারে গত নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সু চির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল জয় পায়। কিন্তু নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে সেনাবাহিনী। তারা পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ১ ফেব্রুয়ারি ভোরে সামরিক অভ্যুত্থান করে।
এদিন সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী সু চির সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। সেনাবাহিনী সু চি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে। জান্তা শাসকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দিন দিন জোরালো হচ্ছে। সঙ্গে দমনপীড়নও জোরদার করছে নিরাপত্তা বাহিনী।
সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে মোট নিহতের সংখ্যা এখন চারশ ছাড়িয়ে গেছে। দেশটির স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থা অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) এক বিবৃতিতে জানায়, শুক্রবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩২৮ ছিল। এরমধ্যে শনিবার দেশটিতে প্রায় দুই মাস ধরে চলা বিক্ষোভে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন; ১১৪ জনের মৃত্যু হয় বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়। এ সংখ্যা এখনো ক্রমবর্ধমান। সর্বশেষ সংবাদ মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে এ পর্যন্ত ৪৫৯ জন নিহত হয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ