বিশেষ প্রতিবেদক : সভ্যতার বিকাশে মুদ্রণ ও সম্প্রচার সাংবাদিকতা বিরাট অবদান রেখে চলছে। বাংলাদেশে মুদ্রণ ও সম্প্রচার সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। সাংবাদিকতার এ দুটি ধারাই বৈচিত্র্যময় এবং স্ফিতকায়, যাকে এখন ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হিসেবে ধরা হয়। প্রথাগত ধারণায় বলা হয়-তথ্য ও বিনোদন পরিবেশনের জন্য মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি বিকশিত হয়েছে। তবে তথ্য ও বিনোদন প্রদানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নীতি-নিষ্ঠতার পরীক্ষায় কিংবা নৈতিকতার চর্চায় প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে মিডিয়ার ভূমিকা। আকারে ও প্রকারে সাংবাদিকতা এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নীতিগর্হিত নানামুখি কর্মকাণ্ডের সাথেও নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে। অথচ নীতি-নিষ্ঠতা সাংবাদিকের পেশাদারিত্বের অন্যতম দাবি।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ‘এথিকস’ কতটুকু মানা হয়? আর নীতিহীন সাংবাদিকতার বিস্তারের কারণই বা কী? প্রশ্ন উঠেছে সাংবাদিকদের দলবাজি নিয়ে৷
দলবাজ সাংবাদিক। এটা একটা পরিচিতিমূলক শব্দবন্ধ। যে সাংবাদিক দলবাজি করে তার জন্য এবং তাকে এটা বলা হয়। অর্থাৎ তার আসল পরিচয় সাংবাদিক, এর সঙ্গে সে কিছুটা দলবাজিও করে।
সাংবাদিকতায় দলবাজির চর্চাটা আগে থেকেই ছিল। তবে ইদানিং এর অবস্থা আরও শক্তিশালী রুপে অবতীর্ণ হয়েছে। কিছু রাজনৈতিক অন্ধ কর্মী ও টাউট যেন সাংবাদিকতায় ঢুকে গেছে! স্পর্শকাতর সময়ে সাংবাদিকসুলভ নির্লিপ্ততার লেশমাত্র তারা রাখতে পারছে না। দলবাজির ‘হক’ আদায় করেই সফল সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছে!
দলবাজ সাংবাদিকের জায়গায় মিডিয়াবাজ রাজনৈতিক কর্মীর প্রাবল্য দ্বন্দ্বমুখর এ পরিস্থিতিটাকে আরো ঘোলাটে করে তুলেছে। সাংবাদিকের দলবাজি একটা স্বতন্ত্র সমস্যা; যে কোনো দেশে এটা বড় রকম অবক্ষয় ও পতনের সূচক। কিন্তু তবু একটা সান্ত্বনার জায়গা এই ছিল যে, দলবাজি করলেও তার মূল পরিচয়টা সাংবাদিক। সাংবাদিকতা ও দলবাজি কখনো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলে যে মানুষটা ন্যূনতম সাংবাদিক, সে সাংবাদিকতার পক্ষে নিজেকে দাঁড় করায়। দলবাজির চাদর কিছুক্ষণের জন্য শরীর থেকে সে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
আরেকটা হচ্ছে, মিডিয়াবাজ দলীয় কর্মী। এই লোকটা আসলে সাংবাদিক না, তার প্রধান পরিচয় হলো, সে দলের অন্ধ-কর্মী। তবে দলবাজি করার জন্য সাংবাদিকতার অঙ্গনটাকে সে বেছে নিয়েছে। তার নিবেদনের জায়গা অন্ধ রাজনীতি। সাংবাদিকতা সেই রাজনীতির ব্যবহারের হাতিয়ার।
যে লোকটা আগাগোড়াই অন্ধ রাজনৈতিক কর্মী, ধান্ধা, পেশা ও জীবিকার ক্ষেত্র হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছে, সাংবাদিকতার জন্য তার পক্ষ থেকে কোনো সুসংবাদ নেই। অন্ধ দলবাজি কখনো সাংবাদিকতার মাথায় কুঠারাঘাত করলেও সে ফেরাতে আসে না, ব্যথিতও বোধ করে না। সাংবাদিকতার জন্য তার মমতা নয়, সাংবাদিকতা কেবলই তার ব্যবহারের বিষয়, তার মমতা ও সমর্পণ সবটুকুই অন্ধ দলবাজির পায়ের কাছে।
এক সময় দেশে দল ও রাজনীতির সাথে যুক্ত সাংবাদিক থাকতো, এখন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত অন্ধ রাজনীতিকের ভিড় বেড়ে গেছে। সাংবাদিকতা ও দলবাজির এই বিবর্তন ও বিকৃতি দেশের ‘পোকায় খাওয়া সাংবাদিকতা’কে ভবিষ্যতে কোথায় নিয়ে ফেলবে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
গত দুই দশকে সংবাদমাধ্যমের বড় একটি অংশ তার গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে। এরমধ্যে বেসরকারি টেলিভিশন এসেছে। এসেছে অনলাইন সংবাদমাধ্যমও। যত বেশি সংবাদমাধ্যম এসেছে, তত বেশি গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে। আর শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, সাংবাদিকরাও দলীয় সাংবাদিকে পরিণত হয়েছেন। আগে যেমন দলীয় মুখপত্র ছিল এখন তেমন দলীয় সাংবাদিকও আছেন। আর সংবাদমাধ্যমগুলোও দলীয় বিবেচনায় সংবাদ পরিবেশন করছে। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম তার গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারছে না। সাংবাদিকরাও তাদের মর্যাদার জায়গাটি হারাচ্ছেন। তাই এখন দলবাজ-দলদাস সাংবাদিক পদবাচ্য দু’টি খুব শোনা যায়।
সাংবাদিকতার নীতিমালা না মানায় অনেক সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে৷ কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন৷ আবার তথ্য বিভ্রান্তিতে পড়ছেন গণমাধ্যমের গ্রাহক৷ এমনকি কোনো কোনো মানুষের জীবনে চরম বিপর্যয়ও নেমে আসছে৷ আর সার্বিকভাবে গণমাধ্যম আস্থার সংকটে পড়ছে৷
সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের নৈতিকতা দুর্বল হয়ে যাওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেখেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, আমাদের দেশে এখন প্রচুর সাংবাদিক হয়ে গেছে৷ এখন যে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা হয় তাই নয়, প্রচুর লোকজন আজকাল ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে যান, যেনতেন প্রেস কার্ড নিয়ে ঢুকে পড়েন৷ এতে করে আমাদের যে প্রাতিষ্ঠানিকতা, সেটা খুব লোপ পাচ্ছে৷ আবার সোশ্যাল মিডিয়ার নাম করেও কিছু লোকজন ভিড়ে যায়৷ এটাও একটা বড় সমস্যা৷ এই কারণে আমরা দেখছি, সাংবাদিকদের নৈতিক দিকগুলো খুবই হালকা হয়ে যাচ্ছে৷ এতে করে সাংবাদিকতার মান বা ভাবমূর্তি সবকিছুই ক্ষুন্ন হচ্ছে৷ নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য সাংবাদিকদের নিজেদেরই এদিকে তাকানো দরকার৷ এটাকে সুষ্ঠু-শোভনভাবে দাঁড় করানো তাদেরই দায়িত্ব৷
তারা মনে করেন, পেশার দিকে সাংবাদিকদের আরো একটু গুরুত্ব দেওয়া, পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য যে ভদ্রতা শেখানো, নৈতিক দিক থেকে এগুলো মেনে চলা- এগুলোর জন্য প্রশিক্ষণ হওয়া দরকার৷ এগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার৷ না হলে সার্বিক সাংবাদিকতায় নৈতিক দিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়বে৷
বলেন, এখন অনেকে হয়তো বলবেন, সংবাদমাধ্যম তো চাপের মুখে আছে। তার তো হাত-পা বাঁধা। এটাকে অজুহাত বলে মনে হয়। চাপ সবসময়ই ছিল। বিশ্বের কোথাও কখনও সংবাদমাধ্যম চাপমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে তার টিকে থাকার জন্যই পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। জনগণের, গ্রাহকের আস্থায় থাকতে হবে। এটাকেই একটি স্বাধীন ব্যবসা হিসেবে দেখতে হবে। সংবাদমাধ্যম অন্য ব্যবসা বা অন্য ধরনের ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হলে স্বাভাবিকভাবেই পরগাছায় পরিণত হবে।
বলেন, সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকের কোনও দল বা কোনও দলের প্রতি সমর্থনকে খারাপ বলে মনে করি না। কিন্তু সেটা সংবাদমাধ্যম বা সংবাদ পরিবেশনে প্রভাব ফেলতে পারবে না। যদি ফেলে তাহলে সেটা দলবাজি। আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের সংবাদমাধ্যমই আছে, যারা প্রকাশ্যেই কোনও দলকে সমর্থন দেয়। কিন্তু সংবাদে তার কোনও প্রতিফলন থাকে না। থাকে না দলবাজি। থাকে না মতলববাজি।
সাংবাদিকতার সঙ্গে নৈতিকতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ একক কোনও সংস্থা না থাকলেও আন্তর্জাতিক একাধিক সংগঠন আছে যারা সাংবাদিকতার নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা রেখে আসছে৷ ডয়েচে ভেলে প্রকাশিত কয়েকটি উদ্যোগের কথা থাকছে নিচে।
এথিক্যাল জার্নালিজম নেটওয়ার্ক
ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ৭০ জন সাংবাদিক, সম্পাদক, গণমাধ্যম মালিক, মিডিয়া সাপোর্ট গ্রুপের সমন্বয়ে এই নেটওয়ার্কটি গড়ে উঠেছে৷ বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকতার ধরন, নৈতিকতা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে হালনাগাদ প্রকাশনা ও তথ্য আছে তাদের ওয়েবসাইটে৷ আছে প্রশিক্ষণের সুযোগ, রিপোর্টিং টুলকিটসহ অনেক কিছু৷
অ্যাকাউন্টেবল জার্নালিজম
বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের কোডস অব কন্ডাক্ট এবং প্রেস কাউন্সিলগুলোর সবচেয়ে বড় তথ্য ভাণ্ডার হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ২০০২ সালে এই উদ্যোগটি যাত্রা করে৷ এটি এথিক্যাল জার্নালিজম নেটওয়ার্কেরই একটি সহযোগী প্রকল্প৷ তাদের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেস কাউন্সিল, প্রেস ক্লাব, সরকার ও বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা মিলিয়ে ৪০০-রও বেশি কোড অব কন্ডাক্ট বা বিধিমালা আছে৷
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার
গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার সাংবাদিকতার মান উন্নয়ন ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যেও কাজ করছে৷ এজন্য ইউরোপীয় সম্প্রচার কমিশন, এএফপি ও গ্লোবাল এডিটর্স নেটওয়ার্কের সহযোগিতায় ২০১৯ সালে ‘জার্নালিজম ট্রান্স ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি উদ্যোগ শুরু করে৷ গণমাধ্যমগুলো কতটা মানসম্মত ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে কাজ করে সেটি স্বেচ্ছায় মূল্যায়নের পদ্ধতি গড়ে তোলা এর উদ্দেশ্য৷
ওএনও
পুরো নাম দ্য অর্গনাইজশেন অফ নিউজ অমবাডসমেন অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস এডিটরস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদ সংশ্লিষ্ট অভিযোগ নিষ্পত্তির দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি ও সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের প্রতিনিধিত্ব করে এই সংস্থাটি।
ওএনও -র উদ্দশ্যে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পৃষ্ঠপোষকতা, স্বচ্ছতার উপর জোর দেয়ার মাধ্যমে গণমাধ্যমের উপর পাঠক-দর্শকের আস্থা বাড়ানো। উদ্দেশ্য পূরণে প্রতিবছর সদস্যদের নিয়ে সম্মেলন করে সংগঠনটি।
গ্লোবাল চার্টার ফর এথিকস ফর জার্নালিস্ট
১৪০ টি দেশের ১৮৭ টি ট্রেড ইউনিয়ন ও অ্যাসোসিয়েশনের ছয় লাখ গণমাধ্যমকর্মীর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস বা আইএফজে।
২০১৯ সালে আইএফজে-র ৩০তম সম্মেলনে গ্লোবাল চার্টার অব এথিকস ফর জার্নালিস্টস ঘোষণা করা হয়। একটি প্রস্তাবনা ও ১৬ টি অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নৈতিকতা বিষয়ে সাংবাদিকদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে এই চার্টারে
এসপিজে
সোসাইটি অব প্রফেশনাল জার্নালিস্টস বা সংক্ষেপে এসপিজে নামে পরিচিত। এটি যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বকারী পুরনো একটি সংগঠন। মার্কিন সংবিধানের ফাস্ট অ্যামেন্ডমেন্টে বর্ণিত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার পাশাপাশি সাংবাদিকতার সর্বোত্তম চর্চা, সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে তারা।
১৯৭৩ সালে সংগঠনটি প্রথম নিজেদের কোড অব এথিকস প্রণয়ন করে, যেটি সবশেষ ২০১৪ সালে সংশোধন করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৪০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ