ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে জেলার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত পাঁচ জন নিহত হয়েছেন। নিহতরা সবাই হেফাজতের কর্মী বলে দাবি করেছেন তাদের স্বজনরা। এ ছাড়া আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। আজ শনিবার(২৭ মার্চ) সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার কুমিল্লা–সিলেট মহাসড়কের নন্দনপুর এলাকায় পুলিশ–বিজিবির সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া শহরের কান্দিরপাড়া এলাকায় ছাত্রলীগ ও মাদ্রাসাছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন নন্দনপুর হারিয়া গ্রামের আবদুল লতিফ মিয়ার ছেলে ওয়ার্কশপের দোকানি জুরু আলম (৩৫), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার দাবিড় মিয়ার ছেলে শ্রমিক বাদল মিয়া (২৪), ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারিউড়া এলাকার মৈন্দ গ্রামের জুরু আলীর ছেলে সুজন মিয়া (২২) ও বুধল ইউনিয়নের বুধল গ্রামের প্লাম্বার শ্রমিক মো. কাউওসার (২২)।
এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৫ জন। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নুরুল আমিন, বাছির মিয়া ও ছাদেক মিয়া নামে চারজনকে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বিকালে নন্দপুর বাজার এলাকায় পুলিশ ও বিজির সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাঁধে। এ সময় বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পর্যায়ক্রমে ৫ জনকে মৃত ঘোষণা করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। আবাসিক চিকিৎসক রানা নুরুস শামস সাংবাদিকদের জানান, এখন পর্যন্ত আহত হয়ে আসা ৫জন মারা গেছেন।
জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গতকালের সহিংসতা, মোদিবিরোধী অবস্থান, হাটহাজারী ও বায়তুল মোকাররমের সামনে হামলার প্রতিবাদে হেফাজত বিকালে কর্মসূচি দেয়। এদিকে হেফাজতের কর্মসূচির বিরুদ্ধে বিকালে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হলে উভয় পক্ষ মুখোমুখি হয়। এসময় উভয়পক্ষে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরপর পুলিশ ও বিজিবি ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে এলে তাদের সঙ্গে হেফাজতের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোঁড়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
হেফাজতের এক কর্মীর দাবি, এসময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ছোঁড়া বুলেটে হেফাজত কর্মীরা গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে আনার পর তাদের মধ্যে কয়েকজন মারা যান।
এদিকে, সদর উপজেলার নন্দরপুরেও গ্রামবাসী ও হেফাজতের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা কর্মসূচির নামে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে সেখানেও আত্মরক্ষায় গুলি ছোঁড়ে বলে পুলিশ দাবি করেছে। সেখানেও কয়েকজন আহত হন।
অন্যদিকে, সরাইল উপজেলায় স্থানীয়দের বের করা বিক্ষোভ মিছিল থেকে পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়েছে। এতে ক্যাম্পে থাকা ২৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। আহত পুলিশ সদস্যদের নাম জানা যায়নি। তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। পুলিশ অন্তত ৪০ রাউন্ড রাবার বুলেট নিক্ষেপ ও ১৫ রাউন্ড টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সরাইল থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হোসেন জানান, বিক্ষোভ মিছিল থেকে হঠাৎ করে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালানো হয়। পুলিশ আত্মরক্ষায় বল প্রয়োগ করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের টিএ রোড দিয়ে আওয়ামী লীগের একটি র্যালি জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার এলাকা অতিক্রম করার সময় পেছন দিক থেকে মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্রকে ধাওয়া করে। এসময় ছাত্ররাও পাল্টা ধাওয়া দেয়। তখন অর্ধশত ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। কিছুক্ষণ পর কান্দিপাড়া মসজিদ থেকে মাদ্রাসাকে রক্ষার জন্য মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেওয়া হলে হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে পড়ে। তখন ছাত্রলীগ কর্মীরা পিছু হটে। ক্ষুব্ধ হেফাজত কর্মীরা প্রধান সড়ক অবরোধ করে রাস্তায় আগুন ধরিয়ে দেয় এবং যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এসময় শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। পরে বিজিবি সদস্য ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এখনো মাদ্রাসা এলাকায় থেমে থেমে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলমান।
এর আগে গতকাল শুক্রবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় মুসল্লি ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মাদ্রাসার ছাত্ররা জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
পুলিশ জানিয়েছে, জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ মিছিল থেকে হাটহাজারী থানায় ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পাল্টা গুলি ছুঁড়েছে পুলিশ। এতে অন্তত ৮ জন গুলিবিদ্ধ ও ৪ জন নিহত হয়েছে।
এদিকে হাটহাজারীতে চারজনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে মাদ্রাসা ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে৷ তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করে৷ এরপর সদর পুলিশ ফাঁড়ির কাছে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হন৷ চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে ও ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় আন্দোলন মিছিলে অন্তত ৫ জন মারা গেছে বলে জানা যায়।
এদিকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং প্রতিবাদের অধিকারকে সম্মান দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। গতকাল শুক্রবার নিজেদের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানায় সংস্থাটি।
এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সমবেত হওয়ার এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকারকে সম্মান করতে হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ‘পুলিশের গুলিতে চারজনের মৃত্যুর ঘটনা’ খবরের পর এমন বিবৃতি দিয়েছে অ্যামনেস্টি।
সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক সুলতান মোহাম্মেদ জাকারিয়া বিবৃতিতে বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম ও ঢাকার সহিংসতার দৃশ্য বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের আচরণের একটি পরিচিত রূপ। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার হামলার শিকার হয়েছে বিশেষ করে এই করোনা মহামারীর সময়ে।’
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার ও সংবিধানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার আছে। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এগুলোকে সম্মান করতে হবে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার রক্ষা ও বেআইনি শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২২৩৭
আপনার মতামত জানানঃ