বিগত এক বছরেরও অধিক সময় ধরে করোনার তুমুল দাপটে অন্যান্য রোগ বিষয়ে মানুষের আতঙ্ক অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তবে রোগ হ্রাস পেয়েছে, এমনটি নয়। করোনার দাপটে এক সময়কার মহামারি যক্ষ্মা চাপা পড়ে থাকলেও তা ছুপা রুস্তমের মতো এখনো মহামারির আসনেই রাজত্ব করে যাচ্ছে। বরং চলতি মহামারি করোনার চেয়ে আরও চারগুণ বেশি ভয়ানক রুপ নিয়ে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে এই যক্ষ্মা। করোনা ভাইরাসের কারণে গত এক বছরে মৃত্যু হয়েছে সাড়ে ৮ হাজারের কিছু বেশি মানুষের যেখানে যক্ষ্মা রোগে গত এক বছরে মৃত্যু হয়েছে ৩৯ হাজার মানুষের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোট যক্ষ্মা রোগী ৩ লাখ ৬১ হাজার। আর যক্ষ্মায় বছরে প্রায় ৩৯ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। শনাক্ত হওয়া রোগীদের ৮১ শতাংশ চিকিৎসাসেবা পায়, ১৯ শতাংশ চিকিৎসার বাইরে থেকে যায়। অন্যদিকে যারা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে, তাদের ৬ শতাংশের চিকিৎসা সফল হচ্ছে না।
জাতীয় যক্ষ্মা নির্মূল কর্মসূচির এক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বৈশ্বিক মহামারি করোনার তুলনায় যক্ষ্মা রোগকে ভয়ানক বলে আখ্যায়িত করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসে গত এক বছরে মৃত্যু হয়েছে সাড়ে আট হাজারের কিছু বেশি মানুষের। অন্যদিকে, যক্ষ্মা রোগে গত এক বছরে মৃত্যু হয়েছে ৩৬ হাজারের বেশি মানুষের। এ হিসাবে করোনার তুলনায় যক্ষ্মা রোগে চার গুণ বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। সুতরাং যক্ষ্মা রোগকে অবহেলা করা যাবে না।’
জাতীয় যক্ষ্মা নির্মূল কর্মসূচির পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিদিন যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১০৭ জনের মৃত্যু হচ্ছে। প্রতিদিন শনাক্ত হয় ৯৮৭ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানে অবশ্য বাংলাদেশে প্রতিদিন যক্ষ্মা রোগে আরও বেশি মৃত্যুর তথ্য দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, প্রতিদিন যক্ষ্মা রোগে ১৮৫ জন মৃত্যুবরণ করছেন। এর বিপরীতে করোনায় প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মৃত্যুবরণ করছেন। এই হিসাব বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, করোনার তুলনায় যক্ষ্মা রোগে ৯ গুণ বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। সচেতন না হলে যক্ষ্মায় মৃত্যু আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবচেয়ে আতঙ্কের তথ্য হলো- যক্ষ্মা রোগীরা উল্লেখযোগ্য হারে করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। রাজধানীর ২৫০ শয্যা শ্যামলী টিবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশ করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। এ ঘটনা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ওই হাসপাতালে আপাতত করোনা পজিটিভ রোগী ভর্তি বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর ২৫০ শয্যার শ্যামলী টিবি হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ও উপপরিচালক ডা. আবু রায়হান গণমাধ্যমকে বলেন, করোনাভাইরাসের মতো যক্ষ্মাও একটি সংক্রামক রোগ। দুটি রোগেই ফুসফুস সংক্রমিত হয়। তার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ থেকে ৩ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। নতুন করে যক্ষ্মা আক্রান্তদের করোনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। আবার করোনা পজিটিভ ব্যক্তিরও যক্ষ্মা পরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও করোনার চেয়ে যক্ষ্মা বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ যক্ষ্মায় মারা যান।
সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো গ্লোবাল ফান্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, যক্ষ্মা রোগে আক্রান্তের তালিকায় বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে রয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর বাংলাদেশে তিন লাখ ৬১ হাজার মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতি লাখে ২২১ জন যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতি লাখে মৃত্যুবরণ করছেন ২৪ জন।
যক্ষ্মাবিষয়ক যৌথ পর্যবেক্ষণ মিশনের একাধিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিশুদের যক্ষ্মা ঠিকমতো শনাক্ত হচ্ছে না। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে যাওয়া রোগী জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। যক্ষ্মা পরীক্ষাগার বা ল্যাবরেটরিগুলো থেকে মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। এসব সমস্যার কথা ২০১৯ সালের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা আছে। এর আগে ২০১০ ও ২০১৬ সালের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনেও এই সমস্যাগুলোর কথা বলা হয়েছিল।
এ বিষয়ে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক সামিউল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘করোনাকালেও যক্ষ্মা ল্যাবরেটরির সংখ্যা ও পরীক্ষার উল্লেখযোগ্য বিস্তার ঘটেছে। শিশু যক্ষ্মা ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার থেকে রোগী জাতীয় কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতি আছে। তবে কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে।’
করোনাভাইরাস মহামারি শেষ হলেও এর প্রভাব গরিবদের ওপর দীর্ঘদিন থেকে যাবে। দীর্ঘদিন রোগ শনাক্ত না হলে এর চিকিৎসা পেতে দেরি হবে। পরিস্থিতি জটিল হবে। মানুষ বেশি আক্রান্ত হবে এবং মারা যাবে। একটি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন অংশে তিন মাসের লকডাউন এবং অন্যান্য কারণে আরও ৬৩ লাখ মানুষ যক্ষ্মা আক্রান্ত হবে এবং ১৪ লাখ মানুষ মারা যাবে।
আজ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস
এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশে আজ বুধবার (২৪ মার্চ) বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এ বছর যক্ষ্মা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘কি ক্লক ইজ টিকিং, ইটস টাইম টু কিপ আওয়ার প্রমিসেস, ইটস টাইম টু এন্ড টিবি’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের জন্য বিশ্বনেতারা কিছু বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০৩৫ সালের মধ্যে সেসব প্রতিশ্রুতি পূরণ করার কথা। কিন্তু সময় আছে অল্প।
অন্যান্য বছরের মতো এবারও জাতীয়ভাবে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালন করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবারের যক্ষ্মা দিবসের প্রতিপাদ্যে কিছু পরিবর্তন এনেছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশে এবারের যক্ষ্মা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘মুজিববর্ষের অঙ্গিকার যক্ষ্মা মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার’।
করোনার কারণে রাজধানীসহ সারাদেশে এ বছর সীমিত পরিসরে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হবে। আজ বুধবার রাজধানীর শ্যামলীর ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শোভাযাত্রা, জনসচেতনতামুলক পোস্টার, লিফলেট বিতরণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাসময়ে শনাক্ত না হলে আর মাঝপথে ওষুধ বন্ধ করে দিলে বিপজ্জনক হতে পারে যক্ষ্মা। বড় একটি অংশই থেকে যাচ্ছে শনাক্তের বাইরে। যারা আক্রান্ত পরে অন্যদের এবং ঝুঁকির কারণ হবে জনস্বাস্থ্যের জন্য।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হলে যক্ষ্মা প্রতিরোধ সম্ভব। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির রিপোর্ট অনুযায়ী, এক দশক আগে যেখানে শনাক্ত রোগীর বিপরীতে সুস্থতার হার ছিল ৯২ শতাংশ, তা এখন ৯৬ শতাংশ। আর মৃত্যুহার ২ দশমিক ৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব কোম্পানি আগে স্বল্পমূল্যে যক্ষ্মা রোগ শনাক্তের যন্ত্রপাতি তৈরি করত, তারা সবাই এখন করোনাভাইরাসের পরীক্ষার আকর্ষণীয় ব্যবসায় নেমেছে।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বিভাগীয় পরামর্শক ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন বলেন, দুই সপ্তাহের বেশি কাশি হলে যক্ষ্মা হতে পারে, এই ধারণা একেবারে সত্যি। কারণ এ সত্যির বশবর্তী হয়ে সে নির্দিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রে যাবে আর পরীক্ষা করাবে। যারা এ ধরনের রোগে ভুগছেন তাদের আমরা এক নেটওয়ার্কে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিটিউ ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহেদুর রহমান খান বলেন, যদি সঠিক ওষুধ ও সঠিক পরিমাণ ডোজ এবং সময় পর্যন্ত অনুসরণ করে থাকে তাহলে কিন্তু কঠিন সমস্যা হয় না।
ডা. শাহেদুর রহমান খান আরও বলেন, সরকারের দেওয়া সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে, সময় চলে যাচ্ছ। কিন্তু আমাদের সেই ধরনের সাফল্যে আসছে না। আরও প্রচারণা দরকার এ ক্ষেত্রে।
আর করোনা মহামারির সময়েও যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়তি সচেতনতার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। পরামর্শ দিচ্ছেন, করোনা আক্রান্ত হলেই এসব ব্যক্তিদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৪৩৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ