আজ ২০ মার্চ বিশ্ব সুখ দিবস। এ দিবসকে সামনে রেখে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। গতকাল আংশিক প্রকাশিত রিপোর্টে ৯৫টি দেশের নাম রয়েছে। আজ শনিবার(২০ মার্চ) বিশ্ব সুখ দিবসে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। এটি টেকসই উন্নয়ন নেটওয়ার্কের সুখবিষয়ক নবম বার্ষিক প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে।
সুখী দেশের তালিকায় এবার ৩৯ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এ বছর ১৪৯ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৬৮তম। ২০২০ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৭তম। ২০১৯ সালে ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৫তম হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশ সুখী দেশ হিসেবে উন্নতি করছে।
রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, এবার বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ২৮০। গত বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪ দশমিক ৮৩৩। তার আগের বছর স্কোর ছিল ৪ দশমিক ৪৫৬। আর ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪ দশমিক ৫০০।
করোনা মহামারির মধ্যেও বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় আবারও শীর্ষে ফিনল্যান্ড। এ নিয়ে টানা ৪ বার বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের স্বীকৃতি পেল দেশটি। করোনা মহামারির কারণে দেশে দেশে মানুষ অবসাদ ও বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হলেও ভিন্ন চিত্র ফিনল্যান্ডে। ২০২০ সালেও বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে ফিনল্যান্ড।
তালিকা অনুসারে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে ফিনল্যান্ডের পরেই রয়েছে, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের নাম।
১৮তম থেকে ১৪তম অবস্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্য ১৭ ও ফ্রান্স ২১তম স্থানে। আর একেবারে নিচের দিকে অবস্থান করছে আফ্রিকার দেশ লেসোথো, বোতসোয়ানা, রুয়ান্ডা ও জিম্বাবুয়ে। অন্যদিকে, সবচেয়ে অসুখী দেশ নির্বাচিত হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান।
ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি সুখী বাংলাদেশের মানুষ। এমনকি বাংলাদেশের লোকেরা শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের লোকেদের চেয়ে বেশি সুখী।দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আংশিক রিপোর্টে বাংলাদেশ অনেক পরে ভারতের নাম রয়েছে। এই তালিকায় ৯৫ দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ৯২তম। সেনাঅভ্যুত্থানের উত্তাল হয়ে উঠা মিয়ানমারের অবস্থান ভারতের উপরে, ৮৯তম স্থানে। চীন আছে ৫২তম অবস্থানে।
আংশিক তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা বা নেপালের নাম নেই।
সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), গড় আয়ু, মানবিকতা, সামাজিক সহায়তা, স্বাধীনতা ও দুর্নীতির ওপর ভিত্তি করে সুখী দেশগুলোর তালিকা করা হয়। কিন্তু এবার এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিও। কোন দেশ কতটুকু ধাক্কা সামলেছে, সে প্রাধান্যও দেওয়া হয়েছে এবারের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে চলমান করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণে ২৭ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু দেখেছে বিশ্ব। শুধু তা–ই নয়, মহামারির ধাক্কা লেগেছে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। এ কারণেই এবারের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে প্রাধান্য পেয়েছে করোনা মহামারি।
রিপোর্টটি করতে ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক বিশ্লেষক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্যালপ এবং লন্ডনভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান লয়েডস রেজিস্ট্রার ফাউন্ডেশনের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া করোনাভাইরাসের তথ্যের জন্য ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউগভের আইসিএল-ইউগভ বিহেভিয়ার ট্র্যাকার ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির কারণে গত বছর বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশেই নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার ছিল। কেবল ২২টি দেশের মানুষ পজিটিভ ছিল। তারা করোনাকে স্বাভাবিক রোগ হিসেবেই ধরে নিয়েছে। পাশাপাশি আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক ছিল।
ফিনল্যান্ডে ভাইরাসের সংক্রমণ পৌঁছালেও তার প্রভাব ছিল কম। ফলে দেশটির বাসিন্দারা উন্নত জীবনযাপন, নিরাপত্তা ও সরকারি সেবা সঠিকভাবে পেয়েছেন। কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি।
এবারের প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী দলে ছিলেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার অধ্যাপক জন হেলিওয়েল। তিনি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, (করোনা পরিস্থিতি সত্ত্বেও) আশ্চর্যজনকভাবে মানুষের ভালো থাকায় গড় হিসাবের দিক থেকে তেমন কোনো নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যায়নি। এর একটি কারণ হতে পারে, মানুষ করোনা মহামারিকে সবার ক্ষেত্রেই বাহ্যিক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। ফলে একধরনের সংহতির সৃষ্টি হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ জন হেলিওয়েল প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলেছেন, বয়স্করা নিজেদের সুস্থ মনে করছেন আগের চেয়ে বেশি। গত বছর ৬০ বছরের বেশি বয়স্কদের মধ্যে গড়ে ৩৬ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা রয়েছে। তিন বছর আগের তুলনায় তা কম (৪৬%)। নারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সমস্যা ৫১ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৪২ শতাংশ। তার মতে, বাস্তবে হয়ত বয়স্করা এতোটা সুস্থ না। কিন্তু করোনা তাদের মানসিক অবস্থা পাল্টে দিয়েছে। তারা করোনার মতো প্রাণঘাতী রোগকে পাশ কাটাতে পেরেছেন বলে নিজেদের সুস্থ মনে করছেন।
এবারের প্রতিবেদনের সহ-সম্পাদক অধ্যাপক জেফরি সাচস বলেন, ‘‘আমাদের দ্রুত কোভিড-১৯ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এই মহামারী আমাদের বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। যার বিরুদ্ধে দ্রুত একজোট হয়ে কাজ করতে হবে।”
করোনা মহামারিতে বদলে গেছে জীবনের সন্তুষ্টির ধারা। এই ভাইরাস বয়স্কদের করেছে উৎফুল্ল। আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকা সত্ত্বেও প্রবীণরা ছিলেন হাসিখুশি। তবে তরুণদের একটি কঠিন বছর পার করতে হয়েছে। তাদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে কয়েকটি ধনী দেশের নারীদেরকে। এবারের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মূল প্রশ্নটি ছিল এমন— মানুষকে এমন একটি সিঁড়ি কল্পনা করতে বলা হয়েছে, যাতে রয়েছে দশটি ধাপ। প্রত্যাশিত সবচেয়ে ভালো জীবনের জন্য সিঁড়ির শীর্ষ ধাপ এবং নিচের ধাপ হলো সবচেয়ে খারাপ জীবনের জন্য। জানতে চাওয়া হয়, আপনি নিজেকে কোন ধাপে রাখবেন? এবারের জরিপে প্রশ্নটির উত্তর ছিল অবাক করার মতো। যেখানে দেখা গেছে, বেদনাময় এক মহামারিতে বিপর্যস্ত পৃথিবী প্রায় আগের মতোই সুখী, প্রায় যেমন সুখী ছিল মহামারির আগে। ৯৫টি দেশের গড় স্কোর ছিল ৫.৮৫। ২০১৭-১৯ সালে যা ছিল ৫.৮১।
ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টের গবেষকরা দাবি করেননি, করোনা মোকাবিলায় সুখের ইতিবাচক কোনও ভূমিকা রয়েছে। তবে তাদের যুক্তি, যেসব দেশে টেকসই জাতীয় সুখ রয়েছে সেগুলো করোনা মোকাবিলার জন্য ভালো অবস্থান তৈরি করেছে। আস্থাই এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
আপনার মতামত জানানঃ