ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছাত্রকে শারীরিক নির্যাতনের দায়ে মঈন উদ্দীন (৪২) নামের এক মাদ্রাসাশিক্ষককে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার (১৮মার্চ) দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ পারভেজ এ রায় দেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত মঈন উদ্দীন জেলা শহরের কলেজ পাড়া এলাকার ক্বারীমীয়া ক্বেরাতুল কোরআন হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। তিনি জেলার সরাইল উপজেলার আখিঁতারার ছাদেকুল ইসলামের ছেলে।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা গেছে, ক্বারীমীয়া ক্বেরাতুল কোরআন হাফিজিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ও শহরতলীর রামরাইলের আ. মালেক হাজারীর নয় বছর বয়সী ছেলে মো. ইব্রাহিমকে শিক্ষক মঈন উদ্দীন ২০১৮ সালের ১১ ও ১৩ আগস্ট দফায় দফায় অমানবিক শারীরিক নির্যাতন করেন। পরে শিশুটির অবস্থা খারাপ হলে নিজেই তাকে চিকিৎসা করান। খবর পেয়ে ইব্রাহিমের অভিভাবক তাকে উদ্ধার করে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
এ ঘটনায় ইব্রাহিমের মা হোসনে আরা বেগম বাদী হয়ে শিক্ষক মঈন উদ্দীনের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। পরে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় বিচারক তাকে ছয় মাসের দণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন এপিপি মোস্তাফিজুর রহমান । তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট মো. নাছির মিয়া। আসামি পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট সৈয়দ তানভীর কাউসার ।
এদিকে দেশের স্কুল-মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের ওপর শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন রোধে নজরদারি বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট। আইনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের ওপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে মাদ্রাসা নামক ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুদের ওপর অমানসিক নির্যাতন চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি এরকম কিছু ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুললে হাইকোর্ট এমন নির্দেশনা দিয়েছে।
আদালতের নির্দেশনাসমূহ:
- দেশের সকল মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলতে হবে।
- মাদ্রাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের মারধর করা, ভয়ভীতি দেখানো যাবে না এমন সরকারি নির্দেশনার বাস্তবায়ন।
- শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাদ্রাসা বোর্ড বিষয়টি নজরদারি করবে, এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
- শিশুটির নিরাপত্তা বিধানের অংশ হিসেবে তার বাড়িতে পুলিশ সদস্য মোতায়েন করতে হবে।
- নির্যাতনের শিকার শিশুটির পড়াশোনা যাতে বন্ধ না হয় সেটি মনিটরিং এ রাখা।
- নির্যাতনের ঘটনা যাতে শিশুটির ভবিষ্যতের ওপর কোন নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে সেজন্য জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
- মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমির প্রিন্সিপালকে সতর্ক করা হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী গত বছর (২০২০) সারাদেশে এক হাজার ৭৪১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ এরমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১২৫টি শিশু৷ এইসব ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে আটটি৷ এই সময়ে শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৪ জন শিক্ষার্থী৷ ছেলে শিশুরাও যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছে৷
গত বছরের নভেম্বর মাসে দেশের কওমি মাদ্রাসায় ৪০ ছেলে শিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর এ তথ্য জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে একটি সংগঠন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা সংবাদ বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যান পেয়েছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। তারা বলছে, এসব ঘটনায় কেবল মামলা হয়েছে, চেপে যাওয়া ঘটনা আরও বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এলাকার মানুষ মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এহেন ঘটনা একদিকে যেমন মেনে নেওয়া যায় না অন্যদিকে লোকসমাজেও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও ছাত্রদের বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হচ্ছে। তারা বলেন, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েও যদি সন্তান নিরাপদ না থাকে তবে অভিভাবকের মনে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিষয়ে আতঙ্ক তৈরি হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/২০১০
আপনার মতামত জানানঃ