মীর মোনাজ হক : আজ বাংলাদেশের জাতীরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের ১০০ বছর পূর্ণ হলো। তাঁর ৫৫ বছরের সংগ্রামী জীবনে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর তিনিই বাঙালি জাতিকে পরিচয় করে দিয়েছেন বিশ্বের কাছে। আজ, তাঁর জন্মদিনে শুধুই আবেগে আপ্লুত না হয়ে, আমার স্মৃতিতে ‘বঙবন্ধু’ ও বাংলাদেশ নিয়ে কিছু কথা, একটি ব্যতিক্রমী স্মৃতিচারণ।
বঙ্গবন্ধুকে আমার তিনবার দেখার সুযোগ হয়েছে প্রথমবার তাঁর কারামুক্তির পর ১৯৬৯ সালে, তখন আমি সবে স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকেছি। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মরত ও প্রাক্তন সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি অফিসারদের বিরুদ্ধে আগতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে পাকিস্তান সরকার। সেই থেকে শুরু হয় গণ আন্দোলন।
১৯৬৯ সালের ছাত্র জনতার গণজাগরণ, যখন উত্তাল, সেই গণজাগরণ রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে তখনই তাঁকে দেখেছি স্বচোক্ষে।
সামান্য কয়েক মাসের মধ্যেই পটপরিবর্তন হতে থাকে। ৪ জানুয়ারি ১৯৬৯ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচী পেশ করে। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ)-এর নেতৃবৃন্দ ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে এবং তাদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১১ দফার মধ্যে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ৬ দফার সাথে ছাত্র সমস্যাকেন্দ্রিক দাবি দাওয়ার পাশাপাশি কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ সংক্রান্ত দাবিসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোরতর হয়। অবশেষে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার করা হয়।
ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ এক সংবাদ সাক্ষাতকারে বলছিলেন, “বঙ্গবন্ধু তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তিনি যদি ছয় দফা না দিতেন আগরতলা মামলা হতো না। এই মামলা না দিলে গণঅভ্যুত্থান হতো না। এই গণঅভ্যুত্থান না হলে তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারতাম না। আর তিনি মুক্তি না পেলে সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হতাম না। আর তিনি যদি নির্বাচনে বিজয়ী না হতেন, তাহলে আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম না”
২৩শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রমনা মাঠে তাঁকে সম্বর্ধনা দেয়া হয় এবং তোফায়েল আহম্মেদের প্রস্তবে তাঁকে ভূষিত করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। সেই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে আমারও লাখ লাখ ছাত্র জনতার মাঝে উপস্তিতিই বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখা।
১৯৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরেও যখন বাঙালিদের ন্যায্য দাবি আদায় হলোনা তখন তিনি ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ বাংলাদেশের স্বপ্ন চূড়ান্ত করা সেই ভাষণ দিলেন। বললেন “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। সেই ঐতিহাসিক জনসভাতেও আমি তাঁকে দেখেছি লাখো জনতার ভিঁড়ে আর একবার।
স্বাধীনতা লাভের প্রতি আকাঙ্ক্ষার স্লোগান স্পষ্টই বুঝিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশের জনগণ আর পাকিস্তানে বসবাস করতে চায় না, জনগণ স্বাধীনতা চায়। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পথটি খুবই কঠিন ছিল, যা জানতেন ও বুঝতেন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি রাষ্ট্র-রাজনীতিকে কত গভীর প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝতেন তা বোঝা গেল ১৮ মিনিটের ইতিহাস কাঁপানো মহান দীপ্ত ভাষণে। এই ভাষণ মুখস্থ বুলি আওড়ানো কিছু শব্দ নয়, প্রানের আবেগ আর রাজনৈতিক চূড়ান্ত প্রজ্ঞার সেই ভাষণ ছিল জাতির মুক্তির রুপরেখা। বঙ্গবন্ধু এক মহাকাব্য রচনা করে গেলেন। দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারন করে গেলেন বাঙালির হাজার বছরের চাওয়া-পাওয়া, দুঃখকষ্টের কথা।
৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ করে ঘরে ফিরে আবার যখন কলেজে ফিরে গেলাম তখন তৃতীয় বারের মত আর একবার বঙ্গবন্ধুকে দেখার সুযোগ হয়েছিলো। সেটা ছিলো অগাস্ট ১৯৭২, বাংলাদেশ ছাত্রইউনিয়নের প্রথম জাতীয়সম্মেলন ঢাকার রমনা মাঠে দুই দিনের মহামিলন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর এলেন প্রধান অতিথি হিসেবে, বক্তৃতা দিলেন মহান নেতা। আমরা তখন রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলাম সিম্বলিক ভাবে অত্যাচারী রাজার যক্ষপুরী থেকে রঞ্জন ও নন্দিনী’কে মুক্তি করে।
যুদ্ধ শেষ হয়েছে। স্বাধীন হয়েছে গোটা একটি দেশ। অনেক প্রাণ আর সম্মানের বিনিময়ে কেনা এই স্বাধীন দেশে পুরস্কৃত হয়েছেন অনেক বীর যোদ্ধা।
বঙ্গবন্ধুও স্বাধীনতার পর মাত্র ৩ বছর ৮ মাস দেশটির হাল ধরতে পেরেছিলেন, ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাঁর দলেরই এক ষড়যন্ত্রকারী।
আজকে তাই তাঁর ১০০ বছরের জন্মদিনে শুধু আনন্দের জয়গান নয়, বেদনার কথাও বলতে হবে।
হে ‘বঙ্গবন্ধু’ তোমার এই সোনার বাংলায় সেদিনের সাতকোটি মানুষ থেকে এখন ১৭ কোটিতে বৃদ্ধি পেয়েছে, পৃথিবীর অন্যান্য জাতীর মতই বাঙালির শিক্ষা, সম্পদ প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বছরে ৬ থেকে ৭% হারে। একই সাথে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে চলছে ১৮% হারে যা পৃথিবীর ধনীরাষ্ট্র গুলির শীর্ষে স্থান পেয়েছে, অন্যদিকে গরীব মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে, তোমার বাংলাদেশের সংসদে এখন ৭০% ব্যবসায়ী রা আইনপ্রনেতা, আর রাষ্ট্রীয় লুটপাট এখন এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে শীর্ষে।
তবুও আজ তোমার জন্মদিনে রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আপনার মতামত জানানঃ