অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকার গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। এরইমধ্যে অর্ধ ডজনেরও বেশি ইউরোপীয় দেশ থেকে টিকাটি বর্জনের ঘোষণা এসেছে। এ টিকায় রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা থেকে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউরোপীয় ওষুধ পর্যবেক্ষক সংস্থা বলেছে, এ টিকা নিরাপদ। এ টিকার ব্যবহার চালিয়ে যাওয়া উচিত। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ব্যবহার চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এই টিকার ব্যবহার স্থগিত না করার জন্য সংস্থাটি বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার সঙ্গে ব্যক্তির শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার যোগসূত্র থাকার কোনো প্রমাণ নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন বলেছেন, তারা চান না যে লোকজন আতঙ্কিত হোক। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাদান চালিয়ে যেতে তারা সুপারিশ করছে।
সৌম্য স্বামীনাথন বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনাগুলোর সঙ্গে এ টিকা নেওয়ার কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাইনি।’
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাদান নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো একই আহ্বান জানিয়েছে দ্য ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (ইএমএ)। তারা বলেছে, এই টিকাদান বন্ধ না করে তা চালিয়ে যাওয়াই উত্তম।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দ্য ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি বিশেষ বৈঠকে বসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা আজ মঙ্গলবার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়ে আলোচনা করবেন। একই দিন বৈঠকে বসছেন দ্য ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সির বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে তারা তাদের পর্যবেক্ষণ জানাবে আগামী বৃহস্পতিবার।
ইউরোপে এই টিকা নেয়ার পর রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। ইউরোপে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ এই টিকার এক ডোজ করে গ্রহণ করেছেন এবং তার মধ্যে ৪০টির মতো রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার ঘটনা জানা গেছে।
এসব ঘটনা সামনে আসার পর গতকাল সোমবার জার্মানির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই টিকার ব্যবহার বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির টিকা বিষয়ক সংস্থার পরামর্শে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ঘোষণা দেয়।
দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রী জেন্স স্পান বলেন, ‘এই টিকার সঙ্গে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার যোগসূত্র পাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
এরপর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোন ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি থেকে নতুন সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত এই টিকার ব্যবহার আপাতত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন।
ইতালির উত্তরাঞ্চলীয় শহর পিয়েদমন্তের আইন প্রয়োগকারীরা এরই মধ্যে বাজার থেকে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৬০০ ডোজ টিকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছেন। অক্সফোর্ডের টিকা গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শহরটির এক বাসিন্দার মৃত্যু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই টিকাগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়।
এর আগে দেশটির দ্বীপাঞ্চল সিসিলিতেও একই ঘটনা ঘটেছে। সেখানেও দুজন ব্যক্তির অক্সফোর্ডের টিকা গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয়। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া ও স্পেন নির্দিষ্ট কিছু চালানের টিকা প্রয়োগ বন্ধ রেখেছে।
এর ধারাবাহিকতায় টিকার ব্যবহার বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও বুলগেরিয়াসহ বেশ কিছু দেশ।
শুধু ইউরোপে নয়, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ স্থগিত হয়েছে এশিয়ায়ও। থাইল্যান্ড শুক্রবার টিকাটির প্রয়োগ স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। তবে গতকালই এ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে দেশটি। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া বলছে, ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদন হাতে আসার আগ পর্যন্ত দেশটি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।
তবে এসব দেশে টিকা ব্যবহার স্থগিত করার পর অ্যাস্ট্রাজেনেকা বলছে, টিকা ব্যবহারের কারণে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার ঝুঁকি থাকার কোনো প্রমাণ মেলেনি। যা আশা করা হয়েছিল, রক্ত জমাট বাঁধার হার তার চাইতে বেশি নয়। এই ঘটনা এখন পর্যন্ত নিবন্ধন পাওয়া সব টিকার ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাদের ভ্যাকসিনের কারণে লোকজনের রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অ্যাস্ট্রাজেনেকার চিফ মেডিকেল অফিসার আন টেলর বলেছেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ আমাদের টিকা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা কয়েকশ-এরও কম।
কোম্পানিটি বলছে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে টিকাটির সুরক্ষার বিষয়টি গভীরভাবে গবেষণা করা হয়েছে।
কোম্পানির একজন মুখপাত্র বলেন, রোগীর সুরক্ষাকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেয়। ওষুধ নিয়ন্ত্রকরা ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা মান মেনেই ভ্যাকসিনকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পিয়ার রিভিউ করা তথ্যেও দেখা গেছে সাধারণভাবে শরীরের জন্য ভালো সহিষ্ণু।
যুক্তরাজ্যের মেডিসিন্স অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্ট রেগুলেটরি এজেন্সি বলছে, ভ্যাকসিন সমস্যা তৈরি করছে এমন কোনও প্রমাণ নেই। মানুষের উচিত ভ্যাকসিন নেওয়া। সংস্থাটির ফিল ব্রায়ান বলেন, রক্তে জমাট বাঁধা স্বাভাবিকভাবেই হতে পারে এবং এটি অস্বাভাবিক না।
যুক্তরাজ্যজুড়ে এক কোটির বেশি মানুষ অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন নিয়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করছে ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি (ইএমএ)। প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে, ভ্যাকসিনটির কিছু ঝুঁকি থাকলেও এর সুবিধা তার চেয়েও বেশি।
যুক্তরাজ্য বলছে, টিকাটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। পোল্যান্ড মনে করছে, টিকার ঝুঁকির চেয়ে সুবিধাই বেশি।
ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি (ইএমএ) জানিয়েছে, গত ১০ মার্চ পর্যন্ত ইউরোপের ৩০টি দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ লোকের ওপর। এর মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেছে ৩০টি।
ইউনিভার্সিটি অব সাদাম্পটনের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মাইকেল হেডের মতে, ফ্রান্স-জার্মানিসহ অন্যদের এ সিদ্ধান্ত পুরোপুরি বিস্ময়কর।
তিনি বলেন, আমাদের হাতে যে তথ্য আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার ঘটনা এটি গ্রহণ না করাদের প্রায় সমান (এমনকি সম্ভবত কম)।
তার মতে, এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, যার কারণে এ ধরনের সিদ্ধান্তকে ন্যায্যতা দেয়া যায়।
২০১৯ সালের শেষ নাগাদ চীনে করোনার প্রথম প্রাদুর্ভাব ছড়ানোর পর এখন পর্যন্ত যত ভ্যাকসিন বাজারে এসেছে, তার মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি সবচেয়ে সস্তা। উন্নয়নশীল বিশ্বে টিকাদান কার্যক্রম মূলত এটিকে কেন্দ্র করেই এগোচ্ছে। যুক্তরাজ্যের নামকরা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও ব্রিটিশ-সুইডিশ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা পিএলসি যৌথভাবে এই টিকা উদ্ভাবন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ টিকার প্রয়োগ চলছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ