দেশে মার্চের প্রথম ২ সপ্তাহে ১১ হাজার ১৭৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। যেখানে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ৭৭ জনের মাঝে। অর্থাৎ মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহেই ফেব্রুয়ারির চেয়ে ১০২ জন বেশি সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন নিয়ে নিজেকে নিরাপদ ভেবে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করায় দেশে সংক্রমণের হার বাড়ছে। একইসঙ্গে যারা ভ্যাকসিন নেননি তাদের মাঝেও স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে তৈরি হয়েছে উদাসীনতা। এমন পরিস্থিতিতে দেশে সংক্রমণের হার বাড়বেই।
গত ১৪ মার্চ দেশে ১৬ হাজার ২০৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে এক হাজার ১৫৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। চলতি বছরের এটি সর্বোচ্চ সংক্রমণ। ২৩ ফেব্রুয়ারির পরে এ দিনই ১৮ জন মৃত্যুবরণ করেছেন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্য বুলেটিন অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত ৪২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে পাঁচ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৫ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ সময়ে দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন আট হাজার ৫৪৫ জন। একই সময়ে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন পাঁচ লাখ ১১ হাজার ৬৯৫ জন।
ফেব্রুয়ারি ও মার্চের তুলনামূলক পরিসংখ্যান
- ফেব্রুয়ারি মাসে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে তিন লাখ ৯২ হাজার ৩০৫টি।
- মার্চ মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে পরীক্ষা করা হয়েছে দুই লাখ ২০ হাজার ৫২৪ জনের নমুনা।
- ফেব্রুয়ারি মাসে ১১ হাজার ৭৭ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়।
- মার্চ মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে ১১ হাজার ১৭৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
- ফেব্রুয়ারি মাসে সংক্রমণের হার ছিল দুই দশমিক ৮২ শতাংশ।
- মার্চ মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে সংক্রমণের হার ৫ দশমিক ০৬ শতাংশ।
- ফেব্রুয়ারি মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান ২৮১ জন।
- মার্চ মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে সংক্রমণে মৃত্যু হয় ১৩৭ জনের।
- ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যু হার ছিল দুই দশমিক ৫৪ শতাংশ।
- মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে মৃত্যু হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, দেশে প্রথম কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এর পর চলতি বছরের ১৩ মার্চ পর্যন্ত পার হয়ে গেছে ৫৩ সপ্তাহ। এ পর্যন্ত দেশে মোট ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৫ জনের করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৮ হাজার ৫৪৫ জন। মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ১১ হাজার ৬৯৫ জন।
দেশে ৪৫তম সপ্তাহে (১০ জানুয়ারি থেকে ১৬ জানুয়ারি) সংক্রমণের হার ছিল পাঁচ দশমিক ৭০ শতাংশ। ৪৫তম সপ্তাহের পরে দেশে সাপ্তাহিক হিসেবে সংক্রমণের হআর কমে আসে পাঁচ শতাংশের নিচে। কিন্তু সংক্রমণের ৫৩তম সপ্তাহে সংক্রমণের হার পাঁচ দশমিক ৬০ শতাংশ হয়। অর্থাৎ টানা সাত সপ্তাহ সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে থাকলেও ৫৩তম সপ্তাহে এটি পাঁচ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ
দেশে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। অনেকে প্রথম ডোজ নিয়েছেন। দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন। এ সময় তো করোনার সংক্রমণ হার ধীরে ধীরে কমে আসার কথা থাকলেও ক্রমাগতভাবে সংক্রমণ বাড়ছে। শঙ্কিত সাধারণ মানুষ।
এর অন্যতম কারণ স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি না মানা। টিকা দেওয়ার পর অনেকের মনে একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে করোনার ঝুঁকি কমছে, তাই আর স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি না মানলেও চলবে। ফলে একটা ঢিলেঢালাভাব চলে আসে।
আগে মাস্ক না পরলে রাস্তাঘাটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীরা জরিমানা করতেন। এখন আর সেই কড়াকড়ি নেই। রাস্তাঘাট, বাজার, শপিং মলে খুব কম মানুষ মাস্ক ব্যবহার করেন।
বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ধুমধামের সঙ্গে চলছে। এসব অনুষ্ঠানে মাস্ক পরার চল প্রায় নেই। ফলে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। করোনা বিশেষজ্ঞদের এই অভিমত অনেকাংশে ঠিক।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, গ্রীষ্মপ্রধান দেশে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু এমন অভিমতও রয়েছে যে গরমে যেহেতু বাতাসের আর্দ্রতা বাড়ে, তাই করোনার সংক্রমণ বাধাগ্রস্ত হয়। এর পেছনে বিজ্ঞানসম্মত কিছু ব্যাখ্যাও রয়েছে। তাই নিশ্চিতভাবে কিছু বলার সময় এখনো আসেনি।
তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে স্বাস্থ্যবিধি সবাইকে কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। কারণ, বুস্টার ডোজ টিকা নেওয়ার অন্তত সাত দিন পার না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না।
টিকা নিয়ে হতে পারেন সংক্রমণের কারণ
বুস্টার ডোজের পরও ঘরের বাইরে চলাফেরায় প্রত্যেকের মাস্ক পরা ও কিছু সময় পরপর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া একান্ত কর্তব্য। কারণ, নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত হলেও ভিড়ের মধ্যে চলাফেরায় আমাদের হাঁচি-কাশি, জোরে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অন্যরা সংক্রমিত হতে পারেন।
বিস্ময়কর হলেও এটি সত্য। ভিড়ের মধ্যে বাতাসে অন্য কারও শ্বাসপ্রশ্বাসে করোনা-ড্রপলেট ঘুরে বেড়ায়। ওই সব ড্রপলেট প্রথমে আপনার শ্বাসতন্ত্রে ঢোকে। কিন্তু আপনি হয়তো সংক্রমিত হবেন না, কারণ টিকা নিয়েছেন। এ অবস্থায় আপনার প্রশ্বাসের সঙ্গে বের হয়ে করোনা-ড্রপলেটগুলো অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে। তাই সবাই মাস্ক না পরলে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন।
টিকা নিয়েও থাকছে সংক্রমণের ঝুঁকি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন যে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হচ্ছে সেটি গড়ে মোটামুটি ১০০ জনের মাঝে ৭০ থেকে ৮০ জনকে সংক্রমণ থেকে নিরাপত্তা দেবে। ২০ শতাংশের মাছে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
এই শঙ্কা এড়ানোর জন্য ও নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। কিন্তু আমরা দেখছি, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে অনেকে রিল্যাক্স হয়ে ঘুরছেন, পিকনিকে যাচ্ছেন যেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না।
এছাড়াও রাজধানীতে যদি দেখা হয় তবে দেখা যাবে এখানেও কিন্ত মাস্ক পরার হার কমেছে। সংক্রমণ তাই বাড়াটা এখানে অস্বাভাবিকভাবে দেখার কিছু নেই।’
তিনি বলেন, ‘যদি কেউ স্বাস্থ্যবিধি না মানে তবে যে কারও মাঝেই কোভিড-১৯ সংক্রমণ হতে পারে। কারণ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়ার ২১ দিন পরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি হতে শুরু করে। এমনকি এর পরেও যে কেউ আক্রান্ত হতেই পারে। আমাদের সবার মনে রাখতে হবে যে, পুরো পৃথিবীতে একটি মহামারি যাচ্ছে। আর ভ্যাকসিন কিন্তু এই মহামারী থেকে সবাইকে নিরাপদ রাখার জন্যেই।
কিন্তু ভ্যাকসিন নিলেই কেউ আক্রান্ত হবে এমনটা কিন্তু এখন পর্যন্ত কোথাও বলা হয়নি। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সময় পর্যন্ত সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এমনকি ভ্যাকসিনের দুই ডোজ নেওয়ার পরও সবাইকে অন্তত মাস্ক পরতেই হবে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা কেন্দ্রের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘দেশে সংক্রমণ বাড়ছে কারণ স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। ভ্যাকসিন দিলেই কেউ কোভিড-১৯ সংক্রমিত হবেন না এই ভাবনাটাই তো ভুল। কারণ সবে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি তৈরি হতেও তো সময় লাগে। এছাড়াও দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়াও সম্ভব না। আর তাই ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবেই।’
তিনি বলেন, ‘সংক্রমণ যদি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তবে অবশ্যই সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। একই সঙ্গে সবাইকে হাত ধোয়ার অভ্যাস চালু রাখতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া জনসমাগমে না যাওয়াই ভালো। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন পিকনিক স্পট ভিড় বাড়ছে। এগুলো বিপদজনক হতে পারে যেকোনো সময়েই। আর তাই স্বাস্থ্য বিধি মানার কোনো বিকল্প নেই।
টিকাই একমাত্র উপায় নয়
দেশে ভ্যাকসিন বিতরণ সংক্রান্ত কোর কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে ভ্যাকসিনই কিন্তু একমাত্র উপায় নয়। ভ্যাকসিন হচ্ছে অনেকগুলোর মাঝে একটিমাত্র উপায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে অনেকেই রিল্যাক্স হয়ে যাচ্ছেন। এটি বিপদজনক। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়েও কিছুটা সচেতনতার অভাব দেখা যাচ্ছে। আর এক্ষেত্রে সংক্রমণ বাড়বেই।’
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকতে হলে সবাইকে অবশ্যই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে কোনো কিছু খাওয়ার আগে ন্যূনতম ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুয়ে নিতে হবে। একই সঙ্গে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। তাহলেই করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে।’
মানুষের উদাসীনতা
মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে উদাসীনতার কারণে সংক্রমণের হার বাড়ছে বলে মনে করেন কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হলেও মাস্ক পরার প্রবণতা ধরে রাখতে হবে। পাশাপাশি মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। অসুস্থ বোধ করলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াটাও জরুরি, যেন প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা শুরু করা যায়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করে দেখলাম, মাস্ক পরা বিষয়ে এক ধরণের উদাসীনতা তৈরি হয়েছে। মানুষ এখন রিল্যাক্স হয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন পিকনিক স্পটে প্রচুর ভিড়। এমনকি সেখানে নাকি মানুষ থাকার জন্য হোটেলও পাচ্ছে না বলে গণমাধ্যমে সংবাদ এসেছে। এক্ষেত্রে সংক্রমণ তো বাড়বেই। কারণ জনসমাগম এড়িয়ে চলাটাও তো একটা স্বাস্থ্যবিধি।’
তিনি বলেন, ‘দেশে বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক কর্মসূচি। এসব স্থানেও প্রচুর মানুষ কিন্তু ভিড় করছে এবং একে অপরের সংস্পর্শে আসছে। এগুলো কিন্তু ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। দেশে যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু সংক্রমণ বাড়ার জন্য অবশ্য এখনই নতুন ভ্যারিয়েন্টকে দায়ী করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন গবেষণা। তবে স্বাস্থ্যবিধি না মানার যে প্রবণতা আমরা দেখছি তাতে নতুন ভ্যারিয়েন্টের প্রয়োজন নেই—এমনিতেই সংক্রমণের হার বেড়ে যাবে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২৬
আপনার মতামত জানানঃ