- দেশে বর্তমানে শিশু কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ।
- এর বিপরীতে বিশেষজ্ঞ কিডনি চিকিৎসক রয়েছে মাত্র ৩৫ জন।
- অর্থাৎ কিডনি রোগে আক্রান্ত প্রতি সোয়া ১ লাখ শিশুর জন্য গড়ে ১ জন বিশেষজ্ঞ কিডনি চিকিৎসক রয়েছে দেশে।
- বিগত ১০ বছরে দেশে হিমোডায়ালাইসিসের আওতায় এসেছে মাত্র ২১৫ জন শিশু।
- দীর্ঘমেয়াদি পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস করেছে ২৬ জন শিশু।
- আর কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে মাত্র ১৩ জন শিশু।
- প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ৩০ হাজার পর্যন্ত ব্যক্তি নতুন ভাবে কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে।
কিডনি রোগের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৫ শিশু কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে এবং প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে এক শিশু কিডনি রোগে আক্রান্ত। চিন্তার বিষয় প্রায় ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ মানুষ কিডিনির রোগ সম্পর্কে অবগত থাকেন না।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি
কিডনি ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কোন না কোনভাবে কিডনি রোগে ভুগছে।
আর আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ হাজারের কিডনি পুরোপুরি অকেজো হচ্ছে প্রতিবছর। এ ধরনের রোগীর জন্য মাত্র দুরকম চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। হয় ডায়ালাইসিস অর্থাৎ যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিডনির কাজ করানো বা কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু এই দুই ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতিই ব্যয়বহুল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পিএনএসবি’র প্রেসিডেন্ট গোলাম মাঈন উদ্দিন বলেন, ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ হাজার শিশুর ক্রনিক কিডনি ডিজিজ আছে, যাদের শতকরা ১০ ভাগ কিডনির বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে শতকরা শূন্য দশমিক এক ভাগ। বিএসএমএমইউতে কিডনি রোগজনিত সমস্যায় বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ৬ হাজার ২০৬ জন রোগী এবং অন্তঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ৫৫৯ জন রোগী। এদের মধ্যে ক্রনিক কিডনি রোগীর সংখ্যা ২২৮ জন। অ্যাকুইট কিডনি রোগীর সংখ্যা ৩৩ জন এবং ১১ জনের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
কিডনি রোগে আক্রান্ত শিশু রোগীর সংখ্যা
দেশে প্রায় ৪২ লাখ শিশু কিডনি রোগে আক্রান্ত যাদের ২০ থেকে ২৫ হাজারের কিডনি বিকল হয়েছে। কেবল কিডনি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেই এদের সুস্থ জীবনে ফেরানো সম্ভব বলে মত চিকিৎসকদের। অথচ অনেকে জানেনই না কিডনিতে ত্রুটি নিয়েই শিশুরা জন্মগ্রহণ করতে পারে।
জন্মের শুরুতেই ডায়ালাইসিসসহ চিকিৎসার নানা খরচ মেটাতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে বহু পরিবার। তাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের দিকেই বেশি জোর দিতে বললেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিদিন গড়ে ১২ জন শিশু কিশোরের ডায়ালাইসিসের পাশাপাশি এখন পর্যন্ত ১৩ জনের কিডনি সফলভাবে প্রতিস্থাপন করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এদের ১১ জনকে মা, বাকি ২ জনকে বাবা ও চাচা কিডনি দান করেছেন।
২০২০ সালে প্রায় তিনগুণ মৃত্যুহার
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যে জানা যাচ্ছে কিডনি জটিলতায় দেশে ২০১৯ সালে যত মানুষ মারা গেছেন, তার প্রায় তিনগুণ মানুষ মারা গেছেন ২০২০ সালে।
১০ই মার্চ প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএসের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৮ হাজার ১৭ জন।
আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে মারা গেছেন ১০ হাজার ৬২২ জন।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা
সাধারণত কিডনির কার্যক্ষমতা ৫০ ভাগেরও বেশি নষ্ট হওয়ার পূর্বে কিডনি বিকলের লক্ষণ না। যাদের বংশে এসব রোগ আছে, যাদের ওজন বেশি, যারা অস্বাস্থ্যকর খাবার খায়, দীর্ঘদিন ব্যথার ওষুধ খাচ্ছে অথবা যাদের কিডনিতে পাথর জমেছে, ঘন ঘন মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ হচ্ছে; তারা সবাই কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছে। এসব রোগীদের অন্তত ছয় মাস পর পর রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
তারা আরো জানান, প্রস্রাব পরীক্ষার অ্যালবুমিন ও রক্তের ক্রিয়েটিনিন থেকে ইজিএফআর নির্ণয় করে কিডনি আক্রান্ত হয়েছে কিনা তা জানা যায়। সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সকল হাসপাতালে এ দুটি পরীক্ষা বিনামূল্যে করানোর সুযোগ থাকলে অঙ্কুরেই কিডনি রোগ শনাক্ত করে তা প্রতিহত করা যাবে।
অধ্যাপক সারোয়ার ইকবাল বলেছেন, একেবারে শেষপর্যায়ে কিডনি অকেজো হওয়ার পর বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসকের কাছে যান।
এই রোগের অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে, নেফ্রাইটিস বা প্রস্রাবের প্রদাহ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ বা অতিমাত্রায় ব্যাথানাশক ঔষধ প্রয়োগ করা এবং খাদ্যাভাস। বংশগত বিষয়ও এই রোগের একটা কারণ হতে পারে।
চিকিৎসকরা বলেছেন, যে সব রোগের কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, সে সব রোগে আক্রান্তরা নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করান না। আর মানুষ এখনও সেভাবে সচেতন হয়ে ওঠেনি বলে তারা মনে করেন।
চিকিৎসা পরিস্থিতির দৈন্যদশা
অধ্যাপক হারুন আর রশিদ বলছিলেন, কিডনির চিকিৎসা বিস্তারে কমিউনিটি হাসপাতালগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
তিনি বলেন, লাভজনক সেন্টারগুলোতো এটা চিন্তাও করে না যে, একজন রোগীকে কত কম খরচে চিকিৎসা দেয়া যাবে। অলাভজনক যেসব সেন্টার আছে, সেগুলো খুবই অপ্রতুল। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা- এমন সাত আটটা শহরে কিছু কিছু ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা আছে এবং সেটা একেবারে নগণ্য। গ্রাম পর্যায়ে এখন এটা চিন্তা করা খুব দুস্কর।
আরও বলেন, কোনোমতেই বাংলাদেশে আগামী ২০ বছরে সব কিডনি রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না। তবে একটা অবকাঠামো আছে, সেটা হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। এই কমিউনিটি ক্লিনিকে যদি উদ্যোগ নেয়া যায়, তাহলে আমরা কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপ-এসব রোগ প্রতিরোধ করতে পারি।
এদিকে, সম্পূর্ণ বিকল হওয়া কিডনি ডায়ালাইসিস বা প্রতিস্থাপনে যে ব্যয় হয় তা দেশের ৯০ ভাগ লোক বহন করতে পারেন না বলেও চিকিৎসকদের গবেষণায় উঠে এসেছে।
প্রতিবার ডায়ালাইসিস করার জন্য বড় অংকের অর্থ গুণতে হয়। এর সাথে তুলনা করলে কিডনি প্রতিস্থাপন বা সংযোজন করার ক্ষেত্রে খরচ কিছুটা কম বলে চিকিৎসকরা বলছেন।
তাদের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, এখন দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। তবে সমস্যা হচ্ছে কিডনি পাওয়াটা বেশ কঠিন।
যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সারাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে কিডনির চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসার ইউনিট করা এবং চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে আনার ব্যাপারে বিভিন্ন পরিকল্পনা বিবেচনা করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/০০৩০
আপনার মতামত জানানঃ