ফ্রান্সে ইসলামবিদ্বেষের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কারণে দেশটির মুসলিমরা এখন তীব্র চাপের মধ্যে রয়েছেন। ২০২০ সালে ফ্রান্সে ইসলামফোবিয়ার কারণে ২৩৫টি ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৯ সালের তুলনায় ১৫৪টি হামলা বেশি হয়েছিল। এ বছর মসজিদে হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৫ শতাংশ। পাশাপাশি ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের ঘটনাও ছড়ানো হয়েছে ব্যাপকহারে।
স্যামুয়েল হত্যাকাণ্ড
গত বছর শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটির মৃত্যুর আগে, তার সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ ছড়ানোর কথা স্বীকার করেছে ফ্রান্সের এক মুসলিম স্কুলছাত্রী।
গত অক্টোবরে শিক্ষক প্যাটিকে মহানবীর (সা.) ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করায় প্যারিসের উত্তর-পশ্চিমের শহরতলী এলাকার রাস্তায় শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়।
যে মেয়েটির অভিযোগ সে সময় অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলেছিল, সম্প্রতি জানা গেছে সে মেয়েটি ঘটনার দিন ক্লাসেই আদৌ উপস্থিতই ছিল না।
প্যাটির হত্যা ফ্রান্সকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল এবং অজস্র মানুষ তার শেষকৃত্যে যোগ দেয়ার পাশাপাশি সারাদেশব্যপী এই হত্যার প্রতিবাদে মিছিলও হয়েছিল। ক্ষোভ জানিয়েছিল দেশবাসী।
পুলিশি তদন্তে নতুন তথ্য
গত বছরের অক্টোবরে শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি বাকস্বাধীনতা ও বর্ণবাদের উপর নেয়া ক্লাসে মহানবীর (সা.) ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করার আগে ক্লাসে কেউ থাকতে না চাইলে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন। এ সময় ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে, যার প্রকৃত নাম জানা যায়নি, ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়। পরে সে অন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানতে পারে, ক্লাসে মহানবীর (সা.) ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করা হয়েছিল। এরপর বাড়ি গিয়ে সে তার বাবা-মাকে বিষয়টি বলে। তখন মেয়েটির বাবা যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের কথাটি জানিয়ে পোস্ট দিলে তা মুহুর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। পুলিশের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে এ সব তথ্য উঠে এসেছে।
মেয়েটির দেয়া প্রমাণাদি থেকে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানতে পেরেছে, মেয়েটি ব্যঙ্গচিত্র নিজে দেখেনি। ক্লাসের অন্য একটি মেয়ে তাকে দেখিয়েছে।
মেয়েটির আইনজীবী বেকো টাবুলা বার্তা সংস্থা এএফপি-কে জানায়, মেয়টি মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছে। কারণ তার সহপাঠীরা তাকে এ ব্যাপারে কথা বলতে উস্কে দিয়েছে।
এরপর মেয়েটির বাবা ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের বিষয়টি। এর পরই আব্দুল্লাখ আজোরোভ নামে ১৮ বছরের এক চেচেন বংশোদ্ভূত যুবক গলা কেটে ওই শিক্ষককে হত্যা করে।
এই হত্যার কিছু পরেই প্রসিকিউটররা বলেছিলেন, এই হত্যার পেছনে প্যাটির বিরুদ্ধে অনলাইনে উস্কানিমূলক প্রচারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। যদিও পুলিশও হত্যাকারী ওই যুবককে গুলি করে হত্যা করে।
সেই মুসলিম ছাত্রীর স্বীকারোক্তি
এরপর জানা যায়, ওই ইতিহাস এবং ভূগোল শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা। যেহেতু তইনি এর আগের বছরও বাকস্বাধীনতার উপর একই ক্লাস নিয়েছিলেন। প্যাটি শিক্ষার্থীদের সতর্ক করে দেয় যে তিনি ক্লাসে মহানবীর (সা.) ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করবেন। কেউ যদি মনে করে এটি তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবে, তাহলে তারা চোখ বন্ধ করতে পারে।
তবে মেয়েটি মূলত অভিযোগ করে বলেছিল, প্যাটি মুসলিম শিক্ষার্থীদের ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। কিন্তু লে প্যারিসিয়েন পত্রিকার সূত্র মতে জানা যায়, প্যাটির ওই ক্লাসের আগের দিন নিয়মিতভাবে অনুপস্থিত থাকার জন্য ছাত্রীটিকে ক্লাস থেকে বহিষ্কার করা হয়।
মেয়েটি তার ফাঁস হওয়া স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছে, সে এই গল্পটি ফেঁদেছিল যাতে করে তার বাবা নিরাশ না হন। মেয়েটির বাবা এই অভিযোগের পক্ষে দু’টি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার দেন।
গত মঙ্গলবার ফ্রান্সের আরটিএল রেডিওতে কথা বলাকালীন প্যাটির পরিবার থেকে নিযুক্ত আইনজীবী বলেন, মেয়েটির পরিবার জানত, সে ওইদিন ক্লাসে উপস্থিত ছিল না এবং কেন তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাহলে এখন তারা আসুক এবং বলুক, হ্যাঁ আমরা আমাদের মেয়ের মিথ্যাকে বিশ্বাস করি।
পথ প্রশস্ত হল ফ্রান্সে ইসলামবিদ্বেষের
এ হত্যার ঘটনাকে ‘ইসলামী সন্ত্রাসী হামলা’ বলে অভিহিত করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শ করেন এবং বলেছেন ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার’ শিক্ষা দিচ্ছিলেন বলে তাকে হত্যা করা হয়েছে। শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে মরনোত্তর লিজিয়ন অফ অনার দেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ। এটাই ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান।
এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেন, আমরা কার্টুন ছাড়বো না৷ ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে রক্ষা করতে গিয়ে প্যাটি জীবন দিয়েছেন । তিনি এই প্রজাতন্ত্রের মুখ।
মহানবীর (সা.) প্রতিকৃতি আঁকা ইসলামে ট্যাবু হয়ে উঠেছে এবং মুসলিমদের কাছে এটি খুবই বড় অপরাধ হিসেবে পরিগনিত হয়।
এছাড়া ফ্রান্সে এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি ঘটনা। এর আগে বিতর্কিত সাময়িকী শার্লি হেবদো মোহাম্মদ (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে। ২০১৫ সালে এই ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের পর ম্যাগাজিনটির অফিসে ইসলামী চরমপন্থীদের হামলায় ১২ জন নিহত হন।
শার্লি হেবদো হত্যাকাণ্ড এবং স্যামুয়েল প্যাটির শিরশ্ছেদ করে হত্যা, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ফ্রান্সের বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে।
এক বক্তব্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, “কোনো ‘ইসলামিস্ট’ ফ্রান্সে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না।”
ফ্রান্সে অব্যাহত হামলা
গত অক্টোবরে শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটির এই হত্যার ঘটনায় মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। তার এ ঘোষণায় আরব বিশ্বে ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের ডাক আসে। ইসলামের প্রতি এমন মানসিকতার জন্য ম্যাক্রোঁর মানসিক চিকিৎসা দরকার বলে মন্তব্য করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান।
ম্যাক্রোঁর মহানবীর (সা.) ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন অব্যাহত রাখার ঘোষণার পর জোড়া হামলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ফ্রান্স জুড়ে। নেয়া হয় সর্বোচ্চ সতর্কতা।
সূত্র মতে, ফ্রান্সের নিস শহরে গির্জায় হামলার তিনজন নিহত হন। এরমধ্যে এক নারীর শিরশ্ছেদ করা হয়।
এর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দক্ষিণাঞ্চলীয় আভিনিওঁ শহরের একটি এলাকায় পুলিশের গুলিতে এক বন্দুকধারী নিহত হন। ওই ব্যক্তি ‘আল্লাহু আকবর’ বলে বন্দুক নিয়ে পথচারী এবং পুলিশের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল।
জাতিসংঘের উদ্বেগ
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-কে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউনাইটেড নেশনস এন্টি-এক্সট্রারেমিজমের (জাতিসংঘের ধর্মীয় স্থাপনার সুরক্ষা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বিষয়ক সংস্থা) প্রধান মিগুয়েল এঞ্জেল মোরাটিনস বলেছেন, ওইসব ব্যঙ্গচিত্রের পুনঃপ্রকাশ বিশ্বের বহু মুসলমানের জন্য অপমানজনক ও ভয়াবহ আক্রমণাত্মক।
ধর্ম ও পবিত্র ধর্মীয় প্রতীকগুলোর অবমাননা ঘৃণা উসকে দেয় এবং সহিংস উগ্রবাদ সমাজকে মেরুকরণ ও খণ্ডিত হওয়ার দিকে ঠেলে দেয়।
ফ্রান্সে ইসলামবিদ্বেষী নতুন আইন
গত বছর ডিসেম্বরে কট্টর ইসলামপন্থার বিরুদ্ধে নতুন আইন পাস করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। আইনটির মূল শিরোনাম দেয়া হয়েছিল ‘বিচ্ছিন্নতাবাদবিরোধী বিল’।
ফ্রান্সের মুসলিমবিরোধী এই নতুন আইনে পরোক্ষভাবে মুসলিম নারীদের ধর্মীয় পোশাক পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ঘরোয়া ইসলামি শিক্ষায় কড়াকড়ি আনা হয়েছে।
বলা হয়েছে, শিশুদের বয়স তিন বছর হলেই বাধ্যতামূলক স্কুল পাঠাতে হবে। কোনোভাবেই ঘরোয়া শিক্ষা দেয়া যাবে না। এছাড়া মসজিদ, মাদ্রাসা, সভা-সমিতি ও ইসলামি কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও সেগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
ফ্রান্সে ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
ফ্রান্সের বর্তমান পরিস্থিতি মুসলিমদের জন্য শঙ্কার। তাদের আরও চাপে রাখতে পরিকল্পনা করছে ফরাসি সরকার। কিছু বর্ণবাদী পত্রিকা সরকারকে এ ব্যাপারে উস্কে দিচ্ছে। সরকারি এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রাজধানী প্যারিসে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়েছে। খবর আনাদোলুর।
এ সময় বিক্ষোভকারীরা বলেন, ফ্রান্সে আগে থেকেই এ বিষয়ে আইনি অনেক উপায় রয়েছে। সুতরাং নতুন এই আইনটি কেবল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধতা বাড়িয়ে তুলবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীদের মতে, ফ্রান্সে মুসলিম শিক্ষার্থীর হাতে এই শিক্ষক নিহত হওয়ার পর দেশটির সংখ্যালঘু ছয় মিলিয়ন মুসলিম ভয়াবহ নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। দেশটিতে বসবাসরত মুসলিমরা সামাজিক বিদ্বেষ, রাষ্ট্রীয় আইনের কঠোরতা ও ধর্মীয় সম্প্রীতির অবনতির সম্মুখীন হচ্ছে। শিক্ষক হত্যার পর ফরাসি সরকারের ত্বরিত ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, মুসলিমদের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করতে ফরাসি আইনে বহুমুখী পরিবর্তন আসতে পারে। ২০১৫ সালে প্যারিসে আইসিআইএলের হামলার পর রাষ্ট্রীয় তৎপরতার কারণে মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকের যেমন নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বলে মনে হয়েছিল, এখনও তেমন হওয়ার আশঙ্কা আছে।
মানবাধিকারকর্মীরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, একশ’ বছর আগে ইহুদি জাতির বিরুদ্ধে ইউরোপের ঘৃণা ও ক্ষোভ মুসলিমদের উপরও তৈরি হতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫৪
আপনার মতামত জানানঃ