আল জাজিরার অনুসন্ধানী ইউনিট এবং ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলের একটি কোম্পানি থেকে ফোন-হ্যাকিং প্রযুক্তি কিনতে প্রায় ০.৩৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যদিও দু’দেশের মধ্যে তেমন কোন কূটনীতিক সম্পর্ক নেই।
সেলেব্রাইট সিকিউরিটি ফার্মের তৈরিকৃত ‘ইউএফডি’ এমন একটি পণ্য যা দূরের মোবাইল ফোন অ্যাক্সেস করতে এবং ডাটা সংগ্রহ করতে সক্ষম। এর এনক্রিপটেড ডাটা হ্যাক করার সক্ষমতা, নাগরিক অধিকার কর্মীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে, যারা এই হ্যাকিং টুলস ব্যবহারে পর্যাপ্ত সতর্কতার কথা বলে আসছেন।
উল্লেখ্য, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ, তাদের সাথে ব্যবসার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং ইসরায়েলিদের বাংলাদেশে ভ্রমণ নিষিদ্ধ। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবেই ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে আসছে, যেহেতু ইসরায়েলি সামরিক শাসনে তাদের নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে মনে করছে দেশটি।
এটা পরিষ্কার নয় যে, ইসরায়েলি কোম্পানি সরাসরি বাংলাদেশকে ‘ইউএফডি’ সরবরাহ করছে নাকি পণ্যটির উৎপত্তিস্থল লুকানোর জন্য পৃথিবীর অন্যত্র অবস্থিত সেলেব্রাইটের কোন সহযোগী প্রতিষ্ঠান দ্বারা সরবরাহ করা হচ্ছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে, আল জাজিরার একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পিকসিক্স নামের একটি ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান থেকে মোবাইল ফোন নজরদারী করার প্রযুক্তির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এর আগে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯-এ পূর্ব ইউরোপীয় দেশ হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের কাছে দু’জন ইসরায়েলি গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর চারজন বাংলাদেশী গোয়েন্দাকে প্রশিক্ষণ দেয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, এই মোবাইল মনিটরিং প্রযুক্তি প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানী থেকে ক্রয় করা হয়েছিল। যদিও এই দাবি নাকচ করেছিল বহির্বিশ্ব।
চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, ‘পিসিক্স ইন্টারসেপ্ট’-এর উৎপাদক পিকসিক্স লিমিটেড, যা কিনা হাঙ্গেরিতে অবস্থিত। কিন্তু শুধু হাঙ্গেরি নয় একমাত্র ইসরায়েল বাদে বিশ্বে অন্য কোনো দেশীয় কোম্পানি ‘পিসিক্স ইন্টারসেপ্ট’ নামের কোনো প্রোডাক্ট বানায় না।
সিঙ্গাপুরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন নয় বাংলাদেশী
আই ইউনিটের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে, বার্তা সংস্থা আল জাজিরা বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে, ২০১৮-১৯ সালে সাক্ষরিত চুক্তির সাথে সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে। এর সাথে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ জড়িত আছে বলে জানা যায়।
জননিরাপত্তা বিভাগ দেশের অভ্যন্তরীণ এবং জনসাধারণের সুরক্ষার জন্য দায়বদ্ধ। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনী এই বিভাগের আওতায় পড়ে।
চুক্তিপত্র থেকে জানা যায়, কীভাবে বাংলাদেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের নয় জন সদস্য ফেব্রুয়ারি ‘১৯-এ ‘ইউএফডি’-এর উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সিঙ্গাপুর যাবার অনুমোদন পান। এই প্রশিক্ষণে তারা শিখতে পারবেন কীভাবে যেকোন দূরবর্তী মোবাইল ফোন থেকে ডাটা সংগ্রহ করতে হয়।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়, র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) যারা কিনা গুম, নির্যাতন ও অপহরণের জন্য সুপরিচিত, তারা সেলেব্রাইট হ্যাকিং সিস্টেমটি ব্যবহারের উপর একটি প্রশিক্ষণের আওতায় আছে। এই প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত একটি প্রোজেক্ট এখন চলমান আছে। যেটা ২০১৯ সালে শুরু হয়েছে এবং ২০২১ সালের জুনে শেষ হবে বলে জানা যায়।
এই ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয় যে বাংলাদেশ সরকার ইলেকট্রনিক সারভেইলেন্স সিস্টেমে বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাশের সিকিউরিটি সার্ভিসেস এমন উন্নত প্রযুক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ যা দ্বারা নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে। এই প্রযুক্তি এনক্রিপটেড ফোনের অ্যাক্সেস পেতে সক্ষম যেখানে ব্যক্তিগত তথ্য উপলব্ধ থাকবে এবং এটি দেশটির মানবাধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ।
ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ২০১৮ সালে পাসকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এই আইনটি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে অনলাইনে সরকার বিরোধী মত প্রকাশের জন্য সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক সক্রিয় কর্মীদের গ্রেফতারের একচেটিয়া ক্ষমতা দিয়েছে।
গত সপ্তাহে, ১৩টি দেশের রাষ্ট্রদূতেরা মুসতাক আহমেদের মৃত্যুর উপর একটি জরুরি তদন্তের ডাক দেন। মুসতাক আহমেদ বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত লেখক, যিনি ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে ন’ মাস কারাগারে থাকার পর মৃত্যুবরণ করেন। মুসতাককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে, করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ে সরকারের পদক্ষেপের উপর ফেসবুকে সমালোচনামূলক মতামত দেয়ায় গ্রেফতার করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে ‘ইউএফডি’ প্রযুক্তির রপ্তানী স্থগিত
ইসরায়েলি মানবাধিকার আইনজীবী ম্যাক ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি রপ্তানির বিরদ্ধে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করছেন। এই প্রযুক্তি মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘনে ব্যবহৃত হতে পারে। এমনকি ২০১৯ সালে হংকং-এর গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীরা কয়েক মাস ধরে আন্দোলন অব্যাহত রাখে এই প্রযুক্তির বিরুদ্ধ । এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ইসরায়েল থেকে যে প্রযুক্তি কিনেছে তা কতোটা বিপদজনক ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য।
ম্যাক আল জাজিরাকে জানায়, আপনি যে কারও ব্যক্তিগত জীবন, তার আত্মীয়পরিজন, চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য, বন্ধুদের নাম, এমনকি সাংবাদিকের ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবেদনের পেছনে থাকা সোর্সের নামও অনায়াসে জানতে পারবেন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে।
‘হং কং-এ পুলিশ এই সেলেব্রাইট সিস্টেম ব্যবহার করে চার হাজার বিক্ষোভকারীর ফোনের তথ্য হাতিয়ে নিয়েছিল।’
সেলেব্রাইট মূলত হংকং-এ বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন এবং ম্যাকের আদালতে করা একটি মামলার কারণে তাদের প্রযুক্তি রপ্তানি বন্ধ করেছিল। গত সোমবার ইসরায়েলি আদালতে ম্যাক একটি পিটিশন দাখিল করেন, বাংলাদেশে প্রযুক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে সেলেব্রাইট এবং পিকসিক্স-এর লাইসেন্স বাতিল করার জন্য।
ম্যাক আল জাজিরাকে বলেন, ‘এমনকি যদি সেলেব্রাইট কিংবা পিকসিক্সের মতো কোম্পানির ব্রাঞ্চ সিঙ্গাপুরে থাকে, তবুও তা ইসরায়েলি আইনের আওতায় পড়ে। কোন কোম্পানির মালিক ইসরায়েলি নাগরিক হলে, রপ্তানির জন্য অবশ্যই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি প্রয়োজন।’
ম্যাক জানান, ইসরায়েল এই ধরণের প্রযুক্তি রপ্তানি করে সে সব দেশের সাথে সুসম্পর্ক তৈরির জন্য যে সব দেশে হরহামেশাই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে যেমন বাংলাদেশ, সাউথ সুদান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
‘বাংলাদেশের কাছে ইসরায়েলি রাইফেল বিক্রির থেকে এই ধরণের প্রযুক্তি রপ্তানি সহজ। ইসরায়েল এই ধরণে প্রযুক্তি বিক্রির মাধ্যমে ওইসব দেশের সাথে গোপন সম্পর্ক তৈরি করে’, ম্যাক জানান।
‘তবে এটা মনে রাখা প্রয়োজন, এই সম্পর্ক ইসরায়েলি জনগণের সাথে বাংলাদেশের কিংবা আমিরাতের জনগণের সম্পর্ক নয়। এই সম্পর্ক ইসরায়েলি সরকারের সাথে ওই দেশগুলোর স্থানীয় সরকারের।’
‘এই ধরণের সম্পর্কের অর্থ, ইসরায়েল বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দমন-পীড়নে সাহায্য করছে।’
আল-জাজিরার আই-ইউনিট বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সেলেব্রাইটের সাথে যোগাযোগ করলে, তারা কোন মন্তব্য করেননি।
সূত্র: আল জাজিরা
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৬
আপনার মতামত জানানঃ