মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার এবং পুনরায় পড়াশোনা শুরু না করার সম্ভাবনাই বেশি। কাজ হারানো এবং বর্ধিত অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে আর্থিক ভার লাঘব করতে পরিবারগুলোকে তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতে বাধ্য করে তুলতে পারে। এই দশক শেষ হওয়ার আগেই অতিরিক্ত এক কোটি শিশুর বিয়ে সম্পন্ন হতে পারে। আজ সোমবার (০৮ মার্চ) জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) প্রকাশিত এক নতুন প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ-এর সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, বাল্যবিবাহের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থতম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে মেয়েদের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ ছেলেদের সমান বা কিছু বেশি হলেও উচ্চশিক্ষা এবং চাকরিতে অনেক পিছিয়ে মেয়েরা। বর্তমানে সরকারি চাকুরেদের মধ্যে নারী মাত্র ২৭ শতাংশ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
মেয়েদের এই পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ। শিশু মেয়ে হয় শিশু মা। ফলে বাড়ে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। বাল্যবিবাহ বন্ধে এখনই উদ্যোগ না নিলে চ্যালেঞ্জ হবে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে। বিশ্বজুড়ে ১৮ বছরের বেশি বয়সে বিবাহিত মেয়েদের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১৫ বছরের কম বয়সি বিবাহিত মেয়েরা।
‘কোভিড-১৯: শিশুবিয়ের বিরুদ্ধে অগ্রগতির জন্য হুমকি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকা, অর্থনৈতিক চাপ, সেবা বিঘ্নিত হওয়া, গর্ভাবস্থা এবং বাবা-মায়ের মৃত্যুজনিত ঘটনা সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা মেয়েদের শিশুবিয়ের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যা বাল্যবিয়ে কমাতে সাম্প্রতিক অনেক বছরের অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
ইউনিসেফ বলছে, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের আগেও ১০ কোটি মেয়ে আগামী দশকে শিশুবিয়ের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি দেশে এটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। গত দশ বছরে বিশ্বব্যাপী শিশু হিসেবে বিয়ে হয়ে যাওয়া তরুণীদের অনুপাত ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল, বা প্রতি চারজনের মধ্যে প্রায় একজন থেকে কমে প্রতি ৫ জনের মধ্যে একজনে পরিণত হয়েছিল, যা প্রায় আড়াই কোটি শিশুবিয়ে প্রতিরোধের সমতুল্য। আর এই অর্জন এখন হুমকির মুখে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে শিশুবিয়ের ব্যাপকতা বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ। লাখ লাখ মেয়েশিশু যে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে তা আরও জটিল করে তুলেছে কোভিড-১৯। স্কুল বন্ধ থাকা, বন্ধুবান্ধব এবং সহায়তা কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য মেয়েদের শিশুবিয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা যদি জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তাহলে মেয়ে শিশুরা যা যা হারাবে (তাদের শিক্ষা, তাদের স্বাস্থ্য ও তাদের ভবিষ্যত) তা তুলে ধরার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, শৈশবে যেসব মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় তারা তাৎক্ষণিক এবং জীবনভর এর পরিণতি ভোগ করেন। তাদের ঘরোয়া সহিংসতার শিকার হওয়া আশঙ্কা বেশি থাকে এবং স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কম। শিশুবিয়ে অল্প বয়সে এবং অপরিকল্পিত গর্ভাবস্থার ঝুঁকি বাড়ায় এবং ফলস্বরূপ প্রসূতির স্বাস্থ্যগত জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়। শিশুবিয়ে মেয়েদের পরিবার ও বন্ধবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে এবং তাদের নিজ কমিউনিটিতে অংশগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সার্বিক কল্যাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।
এতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বর্তমানে জীবিত প্রায় ৬৫ কোটি মেয়ে ও নারীর বিয়ে হয়েছিল তাদের শৈশবে, যার প্রায় অর্ধেকই ঘটেছে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, ভারত ও নাইজেরিয়ায়। কোভিড-১৯ এর প্রভাবগুলো কাটিয়ে উঠতে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুবিয়ের সমাপ্তি ঘটাতে অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ত্বরান্বিত করতে হবে।
তবে বাল্যবিবাহের নানা ধরনের কুফলের বিরুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা ধরনের সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চলমান থাকলেও খুব কমই ঠেকানো যাচ্ছে বাল্যবিবাহ। করোনাকালে বৃদ্ধি পেয়েছে বাল্যবিবাহ। যদিও করোনার প্রথম দিকেই সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছিল, ‘বিশ্বের ৪০ লাখ কন্যাশিশুকে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে ফেলেছে করোনা মহামারি…গত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হতে পারে’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারি দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়িয়েছে। ফলে বাংলাদেশে অনেক কন্যাশিশু স্কুল থেকে বিদায় নিয়েছে ইতিমধ্যেই। কেউ কাজে লেগেছে পরিবারের তাগিদে, নয়তো বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে। স্কুল বন্ধ থাকা, দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়াসহ করোনা সম্পর্কিত নানা কারণ বাল্যবিবাহের ঝুঁকির মুখে পড়েছে বিপুলসংখ্যক কন্যাশিশু। স্কুল বন্ধ থাকলেই তাদের বাল্যবিবাহের ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। লকডাউনের সুযোগে অনেক পরিবার যেমন তাদের মেয়েশিশুদের বাল্যবিয়ে দিচ্ছে এবং এটি গোপন করারও সুযোগ পাচ্ছে। কখনো কখনো স্কুলগুলো মেয়েদের রক্ষা করে বলেই মতপ্রকাশ করেছেন প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাল্যবিবাহের শাস্তি হিসেবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আইনিভাবে কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও সেটির চর্চা খুবই কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়ের পরিবারকেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং সচেতন করা হচ্ছে। কিন্তু ছেলের পরিবার, ঘটক, মৌলভি, কাজি তাঁদের শাস্তি হচ্ছে খুবই কম।
তারা বলেন, যেখানে ৩৫ বছরের ছেলেরা ১৪ বছরের মেয়ে খোঁজেন, সেখানে আসলেই কি বন্ধ হবে এই বাল্যবিবাহ? এই পর্যন্ত যা ঠেকানো হয়েছে তা আদতে খুবই কম। এক জায়গায় ঠেকালেই যে সেই বিয়ে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়, ১০–১৫ দিন পর আবার অন্য জায়গায় গিয়ে সেই বিয়ে হচ্ছে।
এসডব্লিউ/ডিএস/কেএইচ/১৭১৯
আপনার মতামত জানানঃ