রাহাত মুস্তাফিজ
সময়টা ১৯০৮। নিউ ইয়র্ক সিটি শহরে ১৫,০০০ নারী মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। তাঁদের দাবি ছিলোঃ
১। ভোটের অধিকার,
২। সম্মানজনক বেতন এবং
৩। যুক্তিসঙ্গত ও সংক্ষিপ্ত কর্মঘণ্টা
এই নারীরা ছিলেন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। শ্রম শোষণের শিকার এইসব নারীরা তাঁদের ন্যায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। তাঁদের এই আন্দোলন পরবর্তীতে জন্ম দেয় আন্তর্জাতিক নারী দিবসের। সুতরাং এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় নারী দিবসের শেকড় সন্ধান করতে গেলে নিউ ইয়র্ক শহরে সংঘঠিত উল্লেখিত আন্দোলনের কথা বিশেষভাবে বলতে হবে।
এক বছর পরে, অর্থাৎ ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক পার্টি জাতীয় নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়।
তবে দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার ধারণাটি আসে ক্লারা জেটকিনের কাছ থেকে। ক্লারা জেটকিন ছিলেন জার্মান মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, কমিউনিস্ট একটিভিস্ট ও নারী অধিকার বিষয়ে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। ১৯১০ সালে, কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত কর্মজীবী নারীদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে তিনিই প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব করেন। সভায় হাজির থাকা ১৭ টি দেশের ১০০ জন প্রতিনিধি সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটিতে সমর্থন দেন। পরের বছর ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ আনর্জাতিকভাবে প্রথম নারী দিবস পালিত হয়। অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যাণ্ডের ১০ লাখের বেশি মানুষ দিবসটি উদযাপন করে। ৮ মার্চকে নারী দিবস হিসেবে পালন শুরু করে জার্মানি, ১৯১৪ সালে। তারপর থেকে অদ্যাবধি এই দিনটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে অফিসিয়াল স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে নারী দিবস পালন শুরু করে।
নারী দিবস ও নারীবাদ দুটি ভিন্ন প্রপঞ্চ। নারী দিবসের শেকড় নিউ ইয়র্কের শ্রমজীবী নারীদের আন্দোলনের মাঝে প্রথিত হলেও, পৃথিবীর সকল দেশে নারীদের উপর সংঘটিত শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস বিরাজমান ছিলো। নারীবাদ মোটাদাগে ওই বঞ্চনার কথাই হাজির করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একজন শ্রমজীবী প্রান্তস্থ মানুষের শোষণ মূলত অর্থনৈতিক। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একজন নারীকে শোষিত হতে হয় দুইভাবেঃ
প্রথমত, নারী হওয়ার কারণে
দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে অর্থাৎ শ্রম শোষণের মাধ্যমে
শ্রেফ নারী হয়ে জন্ম নেবার কারণে ১৯২০ সালের আগে নারীর ভোটাধিকার ছিলো না। ভোটাধিকার যে একজন নারীর নাগরিক সত্ত্বার অন্যতম প্রকাশ এটা একটা সময় সমাজের অপেক্ষাকৃত অগ্রসর নারীরাও ভাবতে পারতেন না। এমনকি ১৮৪৮ সালে ক্যাডি স্ট্যান্টন যখ্ন প্রথম নারী অধিকার সনদ তথা ‘ডিক্লারেশন অফ সেন্টিমেন্ট’ ঘোষণা করছেন, সেই ১২ দফা সম্বলিত সনদের একটি দফা ছিলো – নির্বাচনে নারীর ভোটাধিকার দিতে হবে। ক্যাডি স্টান্টনের দীর্ঘদিনের বন্ধু লুক্রেশিয়া মোত নারীর ভোটাধিকারের অধিকারের কথা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। এই ঘটনা থেকে অনুমান করা যায় সেই সমাজে নারীর ভোটাধিকারের বিষটিকে তৎকালীন মহাপরাক্রমশালী পুরুষ কীভাবে দেখতেন। এই অবস্থা চলতে থাকে পরবর্তী ১৭০ বছর। ভোটাধিকার, সম্পত্তির অধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীকে অযোগ্য বিবেচনা করা হতো। দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে নারীকে লড়াই করে যেতে হয়েছে। অবশেষে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে নারীর দীর্ঘ আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় নিশ্চিত হয়। সেনেকা ফলস কনভেনশনে উপস্থাপন করা ক্যাডি স্ট্যান্টনের ১২ দফার অন্যতম দফা ভোটাধিকারের দাবী একে একে রাষ্ট্রগুলো মেনে নিতে সম্মত হয়। নারীর এই অর্জনকে নারীবাদী দর্শনে প্রথম তরঙ্গ (ফার্স্ট ওয়েভ ফেমিনিজম)হিসেবে দেখা হয়।
নারীবাদ নিয়ে আমাদের মধ্যে ব্যাপক ভুল ধারণা ও ভ্রান্ত বোঝাপড়া আছে। নারীবাদ অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ চায়। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একক নারী আধিপত্য কায়েম করা নারীবাদের লক্ষ্য নয়, কিংবা পুরুষের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া নয়। বরং নারীবাদ চায় নারী পুরুষের সমতা, সম মর্যাদা ও সমানাধিকারের পৃথিবী। যে পৃথিবীতে নারীকে তাঁর প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে না।
বাংলাদেশে নারীবাদী চেতনার ভ্রুণ এনজিওগুলোর মাধ্যমে জন্ম নেয়। যদিও তাঁদের একটিভিটিকে নারীবাদী একটিভিটি বলা যাবে না। মূলত বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক নারী অধিকার আন্দোলন ও নারীর উপর সংঘঠিত যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি ও এডভোকেসি করাই ছিলো লক্ষ্য যা এখনো বহাল আছে। সে অর্থে নারীবাদ ধারণাটি বাংলাদেশের সমাজে, সাহিত্যে ও বুদ্ধিজীবীতায় স্থান পেতে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে। বিশেষ করে তসলিমা নাসরিন, হুমায়ূন আজাদ, সেলিনা হোসেন ও পরবর্তিতে নাসরিন জাহান, শাহীন আখতার, আকিমুন রহমানের হাত ধরে। যদিও নারীবাদী হিসেবে একমাত্র তসলিমা নাসরিনকে আমরা সনাক্ত করে থাকি। এই সনাক্তকরণ যতটা না তাঁর লেখালেখি ও সৃজনশীলতার কারণে তারচেয়ে বেশি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা-দুর্ঘটনার কারণে।
বাংলাদেশে নারীবাদ চর্চা এখনো শৈশবকাল অতিক্রম করতে পারেনি। তবে ২০১৩ সালের গণজাগরণের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় নারীবাদী পোর্টালগুলোর সৌজন্যে নারীবাদ, নারীবাদী ইত্যাদি শব্দের সাথে প্রতিনিয়ত আমাদের সাক্ষাত হচ্ছে। নারীবাদ বিষয়ে আমাদের মধ্যে আগ্রহ জন্ম নিচ্ছে, একইসাথে নারীবাদের বিরুদ্ধে সামষ্টিক উষ্মা ও নারীবাদীদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে অনুষ্ঠিত সাইবার ক্যাচাল হেতু নারীবাদীদের প্রতি ঘৃণারও বিস্তার ঘটছে।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমাদের জীবনে প্রতি বছর নারী দিবস হাজির হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অধিকারহীনতার সাথে সাথে নারীর প্রতি নির্যাতন, নিপীড়ন, সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এইসব নির্যাতন-নিপীড়নের সূত্রায়ন, সংগায়ন, বিশ্লেষণ ও অনুধাবন জরুরি। পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ সামাজিক-নাগরিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের নারীবাদী একটিভিস্ট ও লেখকগণ নিশ্চয়ই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন।
সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা।
রাহাত মুস্তাফিজ, লেখক, ব্লগার, এক্টিভিস্ট
আপনার মতামত জানানঃ