গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার দক্ষিণ ভাংনাহাটী এলাকায় ঢাকা গার্মেন্টস অ্যান্ড ওয়াশিং লিমিটেড কারখানার কেমিক্যাল গুদামে সকাল ১০টার দিকে আগুন দেখতে পাওয়ার পরপরই শ্রমিকেরা কারখানা থেকে বের হতে চাইলে কর্তৃপক্ষ গেট খুলতে অস্বীকৃতি জানান।
শনিবার (৬ মার্চ) সকাল ১০টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেশ কয়েকবার লাইনে বিদ্যুৎ আসা যাওয়ার ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় পাশের ৫ তলা ভবনের কিছু শ্রমিক ও স্টাফ আগুন নেভাতে গেলে কেমিক্যালের গ্যাসের গন্ধে অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা গেটে উপর্যুপরি আঘাত করলে কর্তৃপক্ষ গেট খুলে দিতে বাধ্য হন।
প্রসঙ্গত, কারখানাটিতে লাগা আগুনে এখন পর্যন্ত একজন শ্রমিকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন আরও ৪২ জন। এদের মধ্যে ১২ জনকে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে।
নিহতের নাম মাসুম সিকদার (২৩) ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার চর কুসুমহাটি গ্রামের সূর্য সিকদারের ছেলে। তিনি ওই কারখানার ওয়েল্ডিং অপারেটর ছিলেন। নিহতের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
হ্যামস ফ্যাশন লি: কারখানার পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার শফিকুর রহমান কারখানায় আগুন লাগার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এখন আমি ঢাকায় আছি। কারখানার ম্যানেজারের নাম্বার চাইলে তা দিতে রাজি হননি।
এদিকে, ভাংনাহাটী গ্রামের নূরুল ইসলামের স্ত্রী খদেজা বেগম (৭৫) জানান, তার দুই নাতি নিখোঁজ রয়েছে। তাদের একজন মনির হোসেনের ছেলে ইউছুফ (৩২) ও হাবিবুর রহমানের ছেলে জয়নাল আবেদীন (৩০)।
শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন কারখানার স্যাম্পল শাখার শ্রমিক আবু হানিফ বলেন, ‘আমি কেমিক্যালের গুদামে আগুন দেখতে পেয়ে একজনকে সেখানে পড়ে যেতে দেখি। পরে তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে গেলে গ্যাসের গন্ধে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে এলে নিজেকে হাসপাতালে দেখতে পাই।’
শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে কর্মরত ডা. কেএম রাজমুল আহসান জানান, কারখানার কমপক্ষে ৪২ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে হাসপাতালে আনা হয়। তাদের মধ্যে ১২ জনকে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে, ১০ জনকে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ও ২০ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আহতদের দেহের বাইরে দগ্ধের আলামত পাওয়া যায়নি। ধোঁয়ায় শ্বাসনালি ও দেহের ভেতরে ইনজুরি হয়ে থাকতে পারে।
শ্রীপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সাদেক জানান, আগুন নেভানোর পর কেমিক্যাল গুদাম থেকে মাসুম সিকদারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি কেমিক্যালের গ্যাসে দম আটকে মারা গেছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তার সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়নি। মরদেহ গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাচ্ছি।
শ্রীপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. মিয়া রাজ জানান, দুটি ইউনিট আধাঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন লাগার সঠিক কারণ তাৎক্ষণিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহফুজ ইমতিয়াজ জানান, সকালে উপজেলার দক্ষিণ ভাঙনাহাটি এলাকায় ঢাকা গার্মেন্ট অ্যান্ড ওয়াশিং লিমিটেড কারখানার টিনশেড গুদামে আগুন লাগে। কারখানার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রায় আধাঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুনে দগ্ধ হয়ে কারখানাটির শ্রমিক মাসুম মারা যান।
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মো. আব্দুল হামিদ জানান, ওই কারখানায় সকালে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই কারখানা কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আগুন নেভাতে সক্ষম হয়।
কর্মস্থলে শ্রমিকের মৃত্যু
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) জানাইয়েছে, ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ৭২৯ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৪৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে পরিবহন খাতে।
বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশের শ্রম ও কর্মক্ষেত্র পরিস্থিতি বিষয়ে সংবাদপত্র ভিত্তিক বিলস্ জরিপ-২০২০’ শীর্ষক এই জরিপ থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে কর্মস্থলে শ্রমিকদের মৃত্যু কমেছে।
সূত্র মতে, গতবছর কর্মক্ষেত্রে নিহতদের মধ্যে ৭২৩ জন পুরুষ ও ছয় জন নারী শ্রমিক। আর মৃত্যুর দিক থেকে নির্মাণ খাত দ্বিতীয় ও কৃষি খাতের অবস্থান তৃতীয়। ৮৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় নির্মাণ খাতে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬৭ জনের মৃত্যু হয় কৃষি খাতে।
এছাড়া দিনমজুর ৪৯ জন, বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ জন, মৎস্য খাতে ২৭ জন, স্টিল মিল শ্রমিক ১৫ জন, নৌ পরিবহন শ্রমিক ১৫ জন, মেকানিক ১৪ জন, অভিবাসী শ্রমিক ১৫ এবং অন্যান্য খাতগুলোতে (ইট ভাটা, হকার, চাতাল, জাহাজ ভাঙা) ৬০ জন শ্রমিক মারা গেছেন।
এছাড়া, ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৪৩৩ জন শ্রমিক আহত হন, এর মধ্যে ৩৮৭ জন পুরুষ এবং ৪৬ জন নারী শ্রমিক। মৎস্য খাতে সর্বোচ্চ ৬৮ জন শ্রমিক আহত হন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নির্মাণ খাতে ৪৯ জন শ্রমিক আহত হন। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ৪৮, পরিবহন খাতে ৪৭, জুতা কারখানায় ২০ জন, নৌ পরিবহন খাতে ১৬ জন, তৈরি পোশাক শিল্পে ৩৭, জাহাজ ভাঙা শিল্পে ২৯, দিনমজুর ১৬, উৎপাদন শিল্পে ১৯ ও কৃষিতে ১০ জন শ্রমিক আহত হন।
এর আগে, ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১২০০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল, এর মধ্যে পুরুষ ১১৯৩ জন ও সাত জন নারী শ্রমিক। খাত অনুযায়ী ওই বছর সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটে পরিবহন খাতে ৫১৬ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নিহতের ঘটনা ঘটে নির্মাণ খাতে ১৩৪ জন। তৃতীয় সর্বোচ্চ নিহতের ঘটনা ঘটে কৃষি খাতে ১১৬ জন। ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৬৯৫ জন শ্রমিক আহত হয়েছিলেন।
শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণের প্রহসন
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’ বিদ্যমান ও বলবৎ আছে। এই আইনটি শ্রমিক নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, সর্বনিম্ন মজুরির হার নির্ধারণ, মজুরি পরিশোধ, কার্যকালে দুর্ঘটনাজনিত কারণে শ্রমিকের জখমের জন্যে ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শিল্প বিরোধ উত্থাপন ও নিষ্পত্তি, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও চাকরির অবস্থা ও পরিবেশ এবং শিক্ষাধীনতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে সকল আইনের সংশোধন ও সংহতকরণকল্পে প্রণীত হয়।
ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে মৃত শ্রমিকের বেলায় ২ লাখ ও স্থায়ীভাবে অক্ষম শ্রমিকের জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আগে ১ লাখ ও ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার বিধান করা হয়েছিল। ক্ষতিপূরণ পূর্ব নির্ধারণ করে রাখা উচিত নয়। বরং ক্ষয় ক্ষতি বিবেচনায় ক্ষতিপূরণ ন্যূনতম মানদণ্ড থাকা উচিত।
এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), মারাত্মক দুর্ঘটনা আইন ১৮৫৫ সালের উচ্চ আদালতের বিভিন্ন নজির (Precedent) অনুসরণ করা যেতে পারে। কর্মক্ষত্রে দুর্ঘটনায় একজন শ্রমিকের মৃত্যুবরণে ২০ লাখ এবং স্থায়ীভাবে অক্ষম ব্যক্তিকে ২৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা উচিত। মৃত শ্রমিকের ক্ষেত্রে অবসর ও অবসরকালীন (Retired) সুযোগ-সুবিধাগুলো বিবেচনা করা । অক্ষম শ্রমিকের ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ বিবেচনায় থাকা দরকার।আবার অস্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ ও কাজ থেকে বিরত থাকা সময়ের সম্ভাব্য মজুরি বিবেচনা করা দরকার। মৃত বা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের পরিবার থেকে একজন সদস্যকে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ দেওয়া। ক্ষতিপূরণ সম্পূর্ণভাবে না দেওয়া পর্যন্ত সর্বশেষ মজুরি প্রদান করতে হবে।
বর্তমান শ্রম আইন ও সংশোধিত প্রস্তাবিত আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রমিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কয়েকটি সুপারিশ:
- ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে আইএলওর (ILO Convention) নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে।
- শ্রম সংক্রান্ত মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR-Alternative Dispute Resolution) পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরী।
- ট্রেড ইউনিয়নকে স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ করে দেওয়া।
- আইনের মাধ্যমে শ্রমিকের চাকরির নিশ্চয়তা প্রদানের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ।
- শ্রম আদালতে (Labor Court) শ্রম সংশ্লিষ্ট মামলার বিচারকার্য শেষ করতে সময় বেঁধে দিতে হবে।
- যৌন হয়রানি বন্ধে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা আসতে হবে।
- শ্রমিকের সুবিধার্থে অধিক শ্রমঘন এলাকায় শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি।
- কর্মক্ষেত্রে যেকোনো প্রকার হয়রানির ও নির্য়াতনে জন্য সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান নিশ্চিতকরণ।
- শ্রমিকদের জন্য দুর্ঘটনা বীমার ও স্বাস্থ্য ইন্সুরেন্স ব্যবস্থা করাও যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ