তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে অন্যান্য খাতের কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
সংস্থাটি জানিয়েছে, গত ৬ মাসে ৮২টি কারখানায় আগুন লেগেছে, যাতে মৃত্যু হয়েছে ১২৮ জনের। সিপিডি কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন।
খ্রিশ্চিয়ান এইডকে সঙ্গে নিয়ে গবেষণাটি করে সিপিডি। এর বিস্তারিত তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক। তিনি জানান, গত ছয় মাসে প্রতি দুই দিনে একটি করে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে দগ্ধ বা আহত হন ২৮৩ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পোশাক খাতের বাইরে অন্য খাতগুলোর কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় শিল্পে নিরাপত্তার বিষয়টি জোরালোভাবে উঠে এসেছে।
নিরাপত্তার অভাবের অন্যতম কারণ হলো অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে বিনিয়োগে আগ্রহী নন উদ্যোক্তারা। সিপিডি মনে করে, এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।
গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, অগ্নিদুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ২৯টি ঘটেছে ঢাকায়। এর বাইরে নারায়ণগঞ্জে ১০টি, গাজীপুরে আটটি এবং চট্টগ্রামে আটটি দুর্ঘটনা ঘটছে।
সিপিডি বলেছে, গত বছরের অক্টোবরে শিল্প খাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বড় ধরনের উদ্যোগ নেয়, কিন্তু সে উদ্যোগের যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
কী বলছে অতীত পরিসংখ্যান?
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০২০ সালে অগ্নিদুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে ১৫৪ জন এবং আহত হয় ৩৮৬ জন। ২০১৯ সালে ১৮৫ জন নিহত ও ৫৭১ জন অগ্নিদুর্ঘটনায় আহত হয়েছে।
২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৪৮৫ জন দুর্ঘটনায় নিহত এবং ৩ হাজার ৮৬৮ জন আহত হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১২৮ জন নিহত ও ৫ হাজার ৮১৭ জন আহত হয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ৩৬৫ জন নিহত এবং ১ হাজার ৭৩২ জন আহত হয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৬৫ জন নিহত ও ১ হাজার ৭৩২ জন আহত হয়েছে।
২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে সংঘটিত স্মরণকালের এক ভয়াবহ মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডেই কেড়ে নেয় ১২৫ জন মানুষের প্রাণ। অনেক মানুষ আহতসহ পুড়ে যায় আশপাশের বেশ কটি ভবন। ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ২২ তলা ভবন এফআর টাওয়ারে ২৬ জন নিহত ও আহত হয়েছেন কম পক্ষে ৭৩ জন।
একই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের বৃহৎ ওয়াহেদ ম্যানসনের দোতলায় মজুদকৃত রাসায়সিক পদার্থের বিস্ফোরণে আগুন লেগে অঙ্গার হলো ৭৯টি তরতাজা প্রাণ। গুরুতর আহত ৪১ জন। ১৯১৭ সালের ৩ জুলাই গাজীপুরের কাশিমপুরের একটি পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে ৫০ জন দগ্ধ হয়।
টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীতে ট্যাম্পাকো ফয়েল লিমিটেড নামের একটি ফয়েল পেপার কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে আগুনে দগ্ধ হয়ে ৩৬ জন নিহত ও শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছিলেন। ২০১২ সালে ২৪ নভেম্বর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কারখানার অগ্নিকাণ্ডে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনসে ১১৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। আহত হয় ২০০ পোশাক শ্রমিক।
আশুলিয়ার নরসিংহপুরে হামীম গ্রুপের একটি অত্যাধুনিক বহুতল পোশাকশিল্প কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে কর্মরত ২৬ জনের মৃত্যু ও শতাধিক আহত হয়। গাজীপুরের চান্দনায় গরিব এ্যান্ড গরিব সোয়েটার কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করেন ২১ জন শ্রমিক।
মহাখালীর একটি নিটিং কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১২ জন শ্রমিক মারা যান যার মধ্যে ১০ জনই ছিলেন নারী শ্রমিক। নরসিংদীর একটি তোয়ালে কারখানার আগুন লেগে ৪৬ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৮ সালে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যার সংখ্যা ১৯ হাজার ৬৪২টি।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুসারে বর্তমানে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ১ হাজার ১৮৭টি, ঝুঁকিপূর্ণ ৩ হাজার ৫১৮টি স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতে রয়েছে ১ হাজার ৬৯টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২ হাজার ৫৮৩টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা। ঢাকায় এসব বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় গড়ে উঠেছে অফিস, গার্মেন্টস, শিল্পকারখানা, মার্কেট ও শপিংমল।
কেন বাড়ছে ঝুঁকি?
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানা গুলোর বেশিরভাগই নজরদারির বাইরে রয়েছে বলেই অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক ফরিদ আহমেদ বলেন, পরিদর্শন একেবারেই হয় না তা নয়। তবে তাদের সীমাবদ্ধতার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
তিনি জানান, আমাদেরকে ওয়ার্কারদের কিছু ব্যক্তিগত অভিযোগ অ্যাটেইন করতে হয়। জবলেস, বেতন সংক্রান্ত এরকম। আমাদের জনবল প্রসঙ্গে বলি, আমাদের ছিল ৩৩৩ জন, এরপরে ৯শ ৩৩ জন হয়েছে।
কিন্তু কিন্তু আমাদের রাইজের সাথে তুলনা করলে আমাদের শিল্পখাতের উন্নয়ন বা কমার্শিয়াল এন্টারপ্রাইজের ডেভলপমেন্টটা আরো দ্রুত হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ে ২ হাজার ৭শ ৮০ জন জনবল চেয়ে জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এছাড়া আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেইফটি ইউনিট গঠনের প্রস্তাব রেখেছি।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে পোশাক খাতের বাইরে শিল্পকারখানার সংখ্যা ৫৬ হাজার ৯শ ৮৭টি।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক কারখানার পরিবেশ আর ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ হলেও শিল্প কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা কাজ হয়নি বলেই অভিযোগ শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন এবং অধিকারকর্মীদের।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বলেন, তদারকি এত দুর্বল, এই দুর্বলতার কারণেই আমরা এতগুলো মানুষ হারিয়েছি। এমন একটা ঘটনা যেটা আমাদেরকে দেখাইছে যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছে শ্রমিকরা।
তিনি বলেন, আমাদের অদেখা কত কারখানায় শ্রমিকরা এভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে, প্রতিনিয়ত এরকম অনিরাপদ জায়গায় কাজ করছে – সেটাতো আমাদের জানাও নাই।
বাংলাদেশে শিল্প কারখানা স্থাপনে নিয়ম-কানুন আর বিধি-বিধান থাকলেও কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলেই দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারাখানা মালিকপক্ষ সেটি অমান্য করেছে বলে অভিযোগ। আর সেই সাথে সামনে আসে কর্তৃপক্ষের নজরদারির অবহেলার বিষয়টিও।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ