হংকংয়ে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখার জন্য চীন বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। সেখানে নিজেদের আইন কার্যকর করার পর এবার হংকংয়ের স্থানীয় নির্বাচনেও নগ্ন হস্তক্ষেপের পথ চূড়ান্ত করেছে বেইজিং। হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন এবং ভূখণ্ডটিতে চীনা নিয়ন্ত্রণ আরো শক্ত করার পর এবার সেখানকার নির্বাচনী ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দিয়েছে চীন।
হংকংয়ের শাসনক্ষমতায় যেন কেবলমাত্র বেইজিংয়ের অনুগতরাই বসতে পারে তা নিশ্চিত করতে গতকাল শুক্রবার(০৫ মার্চ) চীনের আইন প্রণেতারা হংকংয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কথিত ‘দেশপ্রেমিক’রা যেন হংকং এর শাসনক্ষমতায় থাকতে পারে তা নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা উন্মোচন করেছে চীনের শীর্ষ আইনপ্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ। আর এনিয়ে বিশ্বের কোনো দেশ যেন হস্তক্ষেপ না করে এবিষয়েও হুঁশিয়ারি দিয়েছে চীন। এদিকে ঘোষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে চীনের বিরুদ্ধে আরও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
কঠোর নিরাপত্তা আইন চালুর পর হংকংয়ে শুরু হওয়া ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ওই ঘটনার উল্লেখ করে গতকাল শুক্রবার(০৫ মার্চ) পরিকল্পনা উন্মোচনের সময় চীনের এনপিসির ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াং চেন বলেন, হংকংয়ের ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে দেখা গেছে যে সেখানে বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থায় স্পষ্টতই ফাঁক-ফোকর রয়ে গেছে। তিনি বলেন, এই ব্যবস্থায় থাকা ঝুঁকি সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। যাতে করে কেবলমাত্র ‘দেশপ্রেমিকরাই’ অঞ্চলটির শাসন ক্ষমতায় আসতে পারে।
ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে (এনপিসি) চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং স্বাগত বক্তব্যে বহির্বিশ্বকে সতর্ক করে বলেছেন, এ বিষয়ে কেউ যেন নাক না গলায়।
প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং বলেন, হংকং বিষয়ে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ঠেকাতে বেইজিং শক্ত ভূমিকা অব্যাহত রাখবে।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, শুক্রবার ঘোষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে চীনের বিরুদ্ধে আরও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
আগামী এক সপ্তাহ ধরে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের (এনপিসি) সম্মেলন চলবে। এই সম্মেলনেই হংকংয়ের নির্বাচনী ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে প্রস্তুতকৃত খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা হবে। সম্মেলনে অংশ নিতে হাজার হাজার আইনপ্রণেতা এখন বেইজিংয়ে অবস্থান করছেন।
এনপিসি’র ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াং চেন শুক্রবার জানিয়েছেন, ‘হংকংয়ের মৌলিক আইন’র কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হবে। ‘হংকং’স ব্যাসিক ল’ আসলে ভূখণ্ডটির মিনি সংবিধান নামে পরিচিত।
সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন যে আইন প্রণয়ন করা হবে, সেখানে রাজনৈতিক কার্যকলাপ কাকে বলা হবে, তার নতুন করে ব্যাখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। রাজনৈতিক প্রচারও কার্যত বন্ধ করে দেয়া হতে পারে। আর বর্তমান বিতর্কিত নিরাপত্তা আইন অনুসারে এই গণতন্ত্রপন্থীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
ওয়াং চেন আরো বলেন, হংকংয়ের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় কিছু ত্রুটি রয়েছে; যার কারণে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা ভূখণ্ডটির স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলছেন। তার মতে, এই ‘ঝুঁকি’ দূর করা প্রয়োজন। এ ছাড়া হংকংয়ে ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
চীনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে হংকংয়ের সাবেক গভর্নর লর্ড ক্রিস প্যাটেন বলেছেন, চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি হংকংয়ের স্বাধীনতা ধ্বংস করার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন।
১৫০ বছর ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার পর চুক্তির মেয়াদ শেষে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই হংকং-কে চীনের কাছে ফেরত দেয় যুক্তরাজ্য। তখন থেকে অঞ্চলটি ‘এক দেশ, দুই নীতি’র আওতায় স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ভোগ করে আসছে। বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হংকংকে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দিয়েছে চীন। তবে গত বছর জুনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ের জন্য নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করে বেইজিং। এই আইনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চীনের হাতে তুলে দিতে পারবে হংকং কর্তৃপক্ষ। সমালোচকেরা বলছেন,এই আইনের কারণে অঞ্চলটির গণতন্ত্রপন্থী কর্মীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার সুযোগ পাবে চীন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ও ভূখণ্ডটিতে চীনা নিয়ন্ত্রণ আরো শক্ত করার জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হংকংয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের কোনোভাবেই সহ্য করবে না চীনা প্রশাসন। নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে সম্ভবত চীন তার এক দেশ, দুই নীতি থেকে বেরিয়ে আসছে।
এদিকে গত বছর হংকং-এ চীন নতুন নিরাপত্তা আইন চালু করেছে করলে শুরু থেকেই পশ্চিমা দেশগুলি চীনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছে, নতুন আইন হংকং-এর লোকেদের অধিকার ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে। এই আইনে বলা হয়েছে, চীনের সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা যাবে না। বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী কোনও কাজ করা যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির আশঙ্কা, এই আইন ব্যবহার করে হংকং-এ যাবতীয় বিক্ষোভ বন্ধ করে দেবে চীন।
যুক্তরাজ্য হংকং-কে চীনের হাতে তুলে দেওয়ার পর থেকে এতদিন তাদের সঙ্গে বিশেষ বনিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল ইইউ-র দেশগুলি। তবে তারা সবসময়ই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে। কিন্তু সম্প্রতি চীন কড়া আইন করে বিক্ষোভ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে গেছে।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৮৩৮
আপনার মতামত জানানঃ