মামুন আব্দুল্লাহ : ইউরোপের অন্যতম ধনী দেশ সুইজারল্যান্ড। সমগ্র দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৮৫.৪ লক্ষ। জীবন যাত্রার মানের দিক থেকে এটি পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দেশ সমূহের একটি। হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স বা মানব উন্নয়ন সূচকে প্রথম অবস্থানেই রয়ছে নরওয়ে। তাদের এইচডিআই ভ্যালু ০.৯৫৭। এরপরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে আয়ারল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড। তাদের এইচডিআই একই, অর্থাৎ ০.৯৫৫। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় তলানিতে। বাংলাদেশ ১৩৩, ভারত, ১৩১, পাকিস্তান ১৫৪, এবং ভুটান ১২৯।
সুইজারল্যান্ডে অতি সাম্প্রতিক বোরকাকে নিষিদ্ধ করবে কিনা এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রাশিয়ার স্পুটনিক ও কাতারের আল জাজিরা। আল জাজিরার রিপোর্টে উঠে এসেছে সুইজারল্যান্ডের মুসলিম কমিউনিটি বোরকা নিষিদ্ধের জন্য তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন। তাদের মতে, “মুসলমানদের টার্গেট করে বোরকা নিষিদ্ধের যে আইন করা হবে এতে করে যে তারা ইসলামোফোবিক একটা জাতি তা প্রমাণিত হচ্ছে।” সুইজারল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫.২ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে। ইসলাম সুইজারল্যান্ডে খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০৫০ সালের মাঝে সুইজারল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ ইসলাম অনুসরণ করবে যার বেশিরভাগই হবে রিফিউজি ও তাদের বংশধর। সুইজারল্যান্ডের সাড়ে চার লক্ষ মুসলমান এই রেফারেন্ডামের বিরোধিতা করছে। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের বোরকা ব্যান কতটা যৌক্তিক এবং আসলে তারা কতটুকু নিষিদ্ধ করবে আর কতটুকুর অনুমোদন দেবে এটার আলোচনাও মুখ্য।
সুইজারল্যান্ড একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র। তাহলে কেন তারা এমন একটি আইন প্রণয়ন করছে যেখানে অন্যের ধর্ম পালনের অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে? মনে রাখতে হবে, সুইজারল্যান্ড আসলে ইসলামকে টার্গেট করে বোরকা নিষিদ্ধ করছে না। তাদের আইনে থাকবে, “No one shall cover their face in public, nor areas accessible to the public or areas where service are ordinary accessible to all.” লিখিতভাবে এখানে কোন ধর্মের নাম উল্লেখ থাকবে না। কিন্তু শুধু মাত্র টিভি ডিবেট ও পত্রপত্রিকাগুলোতেই ইসলামকে দেখিয়ে বিষয়টিকে বিতর্কিত করা হচ্ছে। তবে, এই প্রস্তাবিত আইনের সাথে ইসলামের যে কোন সম্পর্ক নেই এটা জোর গলায় দাবীও করা যাবে না।
অপরদিকে ইসলামে বেশ কয়েক ধরণের পর্দা প্রথা রয়েছে। যেমন: শাল, হিজাব, আল-আমিরা, খিমার, চাদর, নিকাব ও বোরকা। সুইজারল্যান্ডে যে আইন হতে যাচ্ছে, তাতে শুধু মাত্র নিকাব ও বোরকা নিষিদ্ধের তালিকায় পড়ে যাবে। কিন্তু শাল, হিজাব, আল-আমিরা, খিমার ও চাদর নারী ও পুরুষেরা জনসম্মুখে ব্যবহার করতে পারবেন। বোরকা যদি নিষিদ্ধও করা হয় তবে, রাস্তায় বোরকাধারীদের ধরে ধরে যে জেলে ঢোকানো হবে এটা ভাবাটাও হাস্যকর। তাদের উপরে জরিমানা আরোপ করা হবে।
সুইজারল্যান্ড স্পষ্ট করেই বলেছে, স্বাস্থ্যগত কারণে যে কেউ মাস্ক, পিপিই পরিধান করতে পারবে, ধর্মীয় রীতি-নীতি পালনের ক্ষেত্রেও মুখ মণ্ডল আংশিক ঢেকে রাখতে পারবে। শুধু মাত্র সুইজারল্যান্ডেই না, পৃথিবীব্যাপী ১৬টি দেশে বোরকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মাঝে কিছু মুসলিম দেশ রয়েছে, কিছু অমুসলিম দেশও রয়েছে। তিউনেশিয়া, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, তাজিকিস্তান, লাটভিয়া, বুলগেরিয়া, ক্যামেরুন, চাদ, কঙ্গো-ব্রাজাভিল, গেবন, নেদারল্যান্ড, চীন ও মরক্কোয় বোরকা নিষিদ্ধ। উক্ত দেশ সমূহের মাঝে কিছু রাষ্ট্রে বোরকা নিষিদ্ধ হলেও, হিজাব নিষিদ্ধ না।
সুইজারল্যান্ড আইন পাশ করানোর পূর্বে একটি ভোটিং পোলের আয়োজন করেছে। ফলে বলা মাত্র বোরকা নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে তা নয়। তবুও সার্ভে করে দেখা গেছে ৬৩% জনগণ এই আইনের পক্ষে। ফলে, এটা প্রমাণিত হচ্ছে যে পুরো ইউরোপে ফার রাইট উইং (Far Right Wing) এর উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ডান পন্থায় জনগণ আরও বেশি রক্ষণশীল ও গোঁড়া হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের সংস্কৃতি ও সামাজিক মর্যাদার অক্ষুণ্ণতা নিয়ে বেশ সজাগ থাকে। কিন্তু ফার রাইট উইং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রেসিজম, জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশন, নির্দিষ্ট ধর্ম গোষ্ঠীর উপরে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। এর বড় একটি কারণ সাম্প্রতিক ফ্রান্সে এন্টি-ইসলাম আইন প্রণয়ন করার জন্য। এরপর ইউরোপের বাকী রাষ্ট্রগুলোও ইসলামী সন্ত্রাসবাদ রুখতে একই আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছেন। তারা ইমানুয়েল ম্যাখোরের আদর্শ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। গত সত্তর বছরে সেকুলারিজমের সংজ্ঞা অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে, মানবতার সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়েছে। এখন ধর্ম, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ ও সাধারণ মানুষকে এক করে দেখা হয় না। এই তিনটিকে গুলিয়ে ফেলে সাধারণ মানুষকে ধর্মীয় উগ্রবাদী বানিয়ে দিলে সেটি হয়ে যায় ফার রাইট উইং আইডিওলজি। পৃথিবীব্যাপী ফার রাইট উইং এর উত্থান চলছে সবখানেই। মুসলমানদের মাঝে ইহুদিদের উপরে ক্ষোভ, হিন্দুদের মাঝে মুসলিমদের উপরে ক্ষোভ, সেক্যুলারদের মাঝে ধর্মের উপরে ক্ষোভ। এই ক্ষোভ পৃথিবীকে নরক বানিয়ে রেখেছে।
কিন্তু রাইট উইং ন্যাশনালিজমে সবচেয়ে মুখরোচক শব্দ হ’ল ইসলামোফোবিয়া। পৃথিবীর প্রতিটা দেশেই একটি রাজনৈতিক দল থাকে যারা মুসলিমদের টার্গেট করে। তাদের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আইনত ও সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করে। তখনই একদল লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলা শুরু করে, ওরা ইসলামোফোবিক। কিন্তু মূল সমস্যাটা কোথায় এটা নিয়ে কেউ কখনো আলাপ করে না। ইতোমধ্যে তুরস্ক একটি পার্লামেন্টারি কমিটি খুলে বসেছে, যার কাজ ইউরোপের কোন রাষ্ট্র কতটা ইসলামোফোবিক এটা র্যাংকিং করা। বিষয়টা এমন, কাউকে ভূতের ভয় দেখিয়ে সে কতটা ভয় পাচ্ছে এটা নাম্বার দেওয়া। খেলার জন্য অতি উত্তম খেলা।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ