উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীন যে আচরণ করছে তাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কানাডার সংসদ। হাউস অব কমন্সে গতকাল সোমবার(২২ ফেব্রুয়ারি) এ বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। তবে একই দিনে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে দেওয়া বক্তৃতায় সংখ্যালঘু উইঘুরদের উপরে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ প্রত্যাখান করেছে চীন। উইঘুরে কখনোই কোনো গণহত্যা, বাধ্যতামূলক শ্রম ও ধর্মীয় নিপীড়নের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনে উইঘুর মুসলিমদের প্রতি যে নিপীড়ন চলছে তাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কানাডার হাউস অফ কমন্স। প্রস্তাবটি ২৬৬-০ ভোটে পাস হয়, যেখানে বিরোধী দলের সবাই এবং ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির একটি অংশ ভোট দেয়। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তার মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্য অবশ্য ভোটদানে বিরত ছিলেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পর কানাডা হলো দ্বিতীয় দেশ, যারা উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীনা আচরণকে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দিল।
চীন উইঘুরদের প্রতি গণহত্যা চালিয়ে গেলে ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া শীতকালীন অলিম্পিকের আয়োজন বেইজিংয়ে না করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটিকে আহ্বান জানানোর পক্ষে হাউস অব কমন্স। আইনপ্রণেতারা এ–সংক্রান্ত সংশোধনী পাস করার জন্যও ভোট দেন।
উইঘুরদের প্রতি চীনের আচরণকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও তদন্ত দরকার। ট্রুডোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্ক গারনেউ পার্লামেন্টে ভোটের সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, কানাডার সরকারের পক্ষ থেকে তিনি ভোট প্রদান থেকে বিরত থেকেছেন।
ভোটাভুটির আগে বিরোধী নেতা এরিন ও টুলে বলেন, ‘মানবাধিকারের পক্ষে এ বার্তা দিতেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’
এর আগে চীন সরকার শিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুর ও অন্যান্য মুসলিম জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক-মাত্রায় নিপীড়ন চালিয়ে ‘গণহত্যা’ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে বলে ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। কয়েকদিন আগে বিবিসির এক রিপোর্টে দাবি করা হয়, বন্দিশিবিরে থাকা মুসলিম মহিলাদের উপর পরিকল্পনা করে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন চালাচ্ছে চীন। সেই রিপোর্টকে ঘিরে ফের উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে চীন সবসময়ই এই ধরণের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। একইসাথে করোনাভাইরাস মহামারী এবং উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের যেসব প্রতিবেদন সাম্প্রতিক সময়ে বিবিসি প্রকাশ করেছে, সেগুলোর সমালোচনা করে চীন বিবিসি ওয়ার্ল্ডের সম্প্রচার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
প্রতি বছরই লাইসেন্সের মেয়াদবৃদ্ধির জন্য চীনের প্রশাসনের কাছে আবেদন জানায় বিবিসি। এক বছরের জন্য তাদের মেয়াদও বৃদ্ধি হয়। কিন্তু গত ১১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার চীনের প্রশাসন জানিয়ে দেয়, এবছর তারা বিবিসির মেয়াদবৃদ্ধি করবে না।
এদিকে গতকাল সোমবার জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে দেওয়া বক্তৃতায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে দাবি করেন, তাদের দেশে যথেষ্ট ধর্মীয় স্বাধীনতা ও শ্রম আইন রয়েছে। ফলে উইঘুর মুসলিমরা সমস্ত নাগরিক অধিকার নিয়ে ভালো রয়েছেন। সংখ্যালঘু কতটা ‘সুরক্ষিত’, সেই কথা বোঝাতে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের সরেজমিনে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছে চীন।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত শিনজিয়াং প্রদেশে সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে এবং গোটা প্রক্রিয়া যথাযথ আইন মেনেই চলছে। সেখানে বিগত চার বছরে কোনও বড় ধরনের সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়নি। শিনজিয়াংয়ে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের সাক্ষী উইঘুর মুসলিমরা। এসব থেকে সাফ বোঝা যায় যে সেখানে গণহত্যা, বন্দিশিবিরে জোর করে কাজে বাধ্য করা ও ধর্মীয় নিপীড়নের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এমন অভিযোগ চীনের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করতে আনা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিনজিয়াংয়ের দরজা সবসময় খোলা আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লোকজন যারা শিনজিয়াং পরিদর্শন করেছেন প্রকৃত ঘটনা এবং সত্য জেনেছেন। হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটসকে (জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেল বাচেলেত) শিনজিয়াং পরিদর্শনে স্বাগত জানাচ্ছে চীন।’ ওই অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলিম উইঘুর ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার ভোগ করছে দাবি করেন তিনি। সেখানে ২৪ হাজার মসজিদ আছে বলেও জানান তিনি।
তবে মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, চীন প্রায় দশ লাখ উইঘুরকে গত কয়েক বছর ধরে ক্যাম্পে আটক করে রেখেছে। চীনে প্রায় দেড় কোটি উইঘুর মুসলমানের বাস। জিনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশই উইঘুর মুসলিম। এই প্রদেশটি তিব্বতের মতো স্বশাসিত একটি অঞ্চল। বিদেশি মিডিয়ার সেখানে প্রবেশের ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সূত্রে খবর আসছে, সেখানে বসবাসরত উইঘুরসহ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন চালাচ্ছে বেইজিং। তবে চীন বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
এসডব্লিউ/বিবিসি/কেএইচ/১৯৪৬
আপনার মতামত জানানঃ