কাজী ফয়সাল : সাম্প্রতিক মায়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা এবং নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী অং সাং সুচিকে বিচারের সম্মুখীন করেছে সেদেশের সেনা অভ্যুথানের নেতারা। মায়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব একটি পুরনো বিষয়। অং সাং সুচি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হলেও সেনাবাহিনীর প্রভাব ছিল পূর্বের মতই শক্তিশালী। যার প্রমাণ আবারো সামনে আসে সাম্প্রতিক সেনাবাহিনীর গ্রেফতার অভিযানে। ১ ফেব্রুয়ারি ভোরে প্রধানমন্ত্রী অং সাং সুচি, রাষ্ট্রপতি উইন মিন্ট এবং ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি)র অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয় এবং নাশকতা এড়াতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে তাদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। সম্পূর্ণ বিচারিক প্রক্রিয়া গোপনে সম্পন্ন এবং অভিযুক্তদের আইনি সহায়তা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে। অং সাং সুচি এবং উইন মিন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হলে যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৬ ও ৩ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। এই ধরনের গোপন এবং অবৈধ বিচারিক প্রক্রিয়া মায়ানমারের ইতিহাসে এই প্রথম নয়। বরং এটি বহুদিন ধরে চলে আসা সেনাবাহিনীর অবৈধ ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়ার একটি নতুন সংযোজন।
পৃথিবীর ইতিহাসে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের পূর্বে এতো বড় আনুষ্ঠানিক যুদ্ধাপরাধের বিচার কখনো হয়নি। এই বিচারকার্যের সময়কাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৪৫ সাল। এই বিচারকার্যের প্রায় সকল দলিলাদি ঐতিহাসিকভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। এই ট্রায়ালে জার্মানির নাৎসির শীর্ষ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিলো। আসামী পক্ষ দাবী করে যে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ আনিত হয়েছে তা মূলত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ল’র কার্যকর হওয়ার পূর্বে সংঘটিত। এই বিষয়ে জার্মান তাত্ত্বিক গুস্তাভ রাডব্রুস এর মত হল, ঘৃণ্য নাৎসি আইন অনুযায়ী যেসকল অপরাধ করা হয়েছে, সেটি কোন আইনই নয় বা আইনের পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। ফলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধপরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া অবশ্যই ন্যায্য।
বিচারে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ল’ এর তৎকালীন অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ সত্যি বলে দাবী করা হয়নি। তবে নাৎসি বাহিনীর সকল অপরাধ কাযক্রম এই আইনের আওতাভুক্ত নাও হতে পারে বলে বিচারিক আদালত মত ব্যক্ত করে।
মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র পতনের পরে দেশগুলো গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করে এবং সমাজতন্ত্রের অধীনে বিভিন্ন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। উল্লেখযোগ্য ভাবে, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে গনঅভ্যুত্থান দমন ও পূর্ব জার্মানি থেকে পলায়নরতদের হত্যার মত বিষয়গুলোতে জড়িতদের আইনের সম্মুখীন করা হয়। তবে আসামী পক্ষ দাবী করে যে এই বিচারিক প্রক্রিয়া গোপনে পরিচালনা করা ছাড়াও, “অপরাধী কে শুধুমাত্র সে অপরাধের শাস্তি দেয়া যাবে যা অপরাধ সংগঠনকালীন সময়ে বিদ্যমান আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য ছিল” এই নিয়মের বহির্ভূত হওয়ায় এটি ইউরোপিয়ান কনভেনশনকে লঙ্ঘন করে। ফলে প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ এবং অবৈধ। কিন্তু অভিযুক্তদের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্টত লঙ্ঘন বলে ইউরোপিয়ান মানবাধিকার আদালত দাবী করে এবং সেই আইন তৎকালীন সমাজতন্ত্রে কার্যকর ছিল কি-না সেটা বিবেচ্য হবে না বলে জানায়।
তবে এখনও বিশ্বব্যাপী বানোয়াট বিচার ব্যবস্থা এবং তাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মত ঘটনা ঘটে চলেছে। মায়ানমার তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেও, একমাত্র নয়। ইউরোপে এ ধরনের ঘটনার অনেক নজির আছে। রোমানিয়ার স্বৈরশাসক নিকোলাই চাসেক্সু এবং তার স্ত্রীকে সামরিক ট্রায়ালে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো ১৯৮৯ সালের বড়দিনে, যা বিচারিক আইন এবং তার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
ইরাকের সাদ্দাম হুসেইনের বিচার প্রক্রিয়াকেও এখানে উপস্থাপন করা যেতে পারে যেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং অসামঞ্জস্যতা খুব স্পষ্টভাবে লক্ষণীয় ছিল। আসামীপক্ষের আইনজীবী এবং সাক্ষীদের ভয় দেখানো থেকে শুরু করে হত্যা করার নজিরও এই ট্রায়ালে ছিল।
অনেক্ষেত্রেই শাসকগোষ্ঠী তাদের অপকর্মকে বিচারের বাইরে রাখার জন্য আইন তৈরি করে। আর্জেন্টিনা এবং চিলিতে সামরিক শাসনের পতনকালে এরকম আইন প্রনয়নের মাধ্যমে নিজেদেরকে ভবিষ্যৎ বিচারিক ব্যবস্থার বাইরে রাখার জন্য আদেশ জারি করে।
মায়ানমারে অং সাং সুচিসহ বাকিদের বিরুদ্ধে যে ট্রায়াল তৈরি করা হয়েছে তা মূলত সামরিক ট্রায়াল যা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপযুক্ত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একচেটিয়া আদালত কার্যক্রম। এরকম বিচারিক আইন প্রশ্ন তোলে যে অবৈধ সরকার বা শাসক দ্বারা প্রণীত আইন কি আদৌ বৈধ? কিভাবে অবৈধ সরকার নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সেই আইনসমূহ প্রয়োগ করতে পারে?
আপনার মতামত জানানঃ