বিশেষ প্রতিনিধি : তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সোশ্যাল মিডিয়া যেনো পৃথিবীর ফুসফুস। অদৃশ্য অসংখ্য সুতোয় বেঁধে দিয়েছে মানুষের স্বাধীনতা। অর্থনীতি থেকে শুরু করে গণতন্ত্র, কতটা গভীরে পৌঁছে গেছে এর শেকড়, তা অনুমান করা বেশ কষ্টসাধ্য। একে বলা যেতে পারে ‘দেয়ালের কান’। গুগল, ফেসবুক কিংবা ইউটিউব আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকেও খুব সহজই প্রভাবিত করতে পারে আমাদের অজান্তেই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর দৌরাত্ম্য নিয়ে নতুনভাবে বিতর্ক সামনে এসেছে সম্প্রতি। অস্ট্রেলিয়া সরকারের মিডিয়া সংক্রান্ত নতুন প্রস্তাবিত আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় নিজেদের প্লাটফর্মে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর কনটেন্ট শেয়ারিং বন্ধ করে দিয়েছে ফেসবুক। এরপর থেকে ফেসবুকে কোনও রকম খবর দেখতে পারছিলেন না অস্ট্রেলিয়ানরা। এমনকি শেয়ারও করা যাচ্ছিল না আন্তর্জাতিক বা দেশের কোনও খবরের লিঙ্ক। সরকারের স্বাস্থ্য, জরুরি পরিস্থিতিসহ আরও কয়েকটি পেজও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজ়িল্যান্ডে ফেসবুকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর উইলিয়াম এস্টন জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়া এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রকাশনা সংস্থাগুলি এবং অস্ট্রেলিয়ার গ্রাহকেরা ফেসবুকে কোনও খবরের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারবেন না। এমনকি কোনও খবর দেখাও যাবে না। পাশাপাশি ফেসবুকে অস্ট্রেলিয়ার খবর দেখতে পাওয়া যাবে না অন্যান্য দেশেও।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ফেসবুকের এই পদক্ষেপকে ‘আনফ্রেন্ড অস্ট্রেলিয়া’ হিসেবে অভিহিত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার বাইরেও ব্যাপক সমালোচনা পোহাতে হচ্ছে ফেসবুককে।
অস্ট্রেলিয়ার বিরোধী দলের নেতা অ্যান্থনি আলবানিজও মরিসনের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেছেন, সাংবাদিকতা যদি টিকিয়ে রাখতে চায়, তাহলে ফেসবুককে গণমাধ্যমগুলোকে অর্থ পরিশোধের ব্যাপারটা মেনে নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, অস্ট্রেলিয়ার অনলাইন বিজ্ঞাপন রাজস্বের ৫৩ শতাংশই গুগল এবং ২৩ শতাংশ ফেসবুকের হাতে আছে।
কী আছে এই প্রস্তাবিত আইনে
অস্ট্রেলিয়া সরকারের মতে, গুগল এবং ফেসবুকের মতো সংস্থাগুলি স্থানীয় সংবাদ সংস্থাগুলির খবর বিনা খরচে প্রচার করে। যদিও এখান থেকে বিজ্ঞাপনে তাদের আয় গগনচুম্বী। এ কারণে স্থানীয় সংবাদ সংস্থাগুলির বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে গেছে।
এই বৈষম্য দূর করতে স্কট মরিসন সরকার ঘোষণা করেন, খবর দেখানোর জন্য ফেসবুক, গুগলকে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থাগুলিকে চুক্তি অনুসারে অর্থ দিতে হবে। দেশটির সরকারের প্রস্তাবিত এই আইন গুগল-ফেসবুকের মতো বৃহৎ ইন্টারনেট জায়ান্টের ব্যবসা নীতির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। যদিও এই শর্ত গুগল মেনে নিয়েছে, তবে ফেসবুক মানেনি।
দ্বন্দ্বের সূত্রপাত
হুট করেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি ফেসবুক। অস্ট্রেলিয়ার সরকারের ফেসবুক এবং গুগলের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এর সূত্রপাত গত ডিসেম্বরে। অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে খবরের প্রচার নিয়ে একাধিক বিষয় উল্লেখ করে একটি আইন পাশ করা হয়। যদিও পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে আইনটি নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে।
এ প্রসঙ্গে ফেসবুকের বক্তব্য, ওই আইন জারি হলে তাদের পক্ষে তা মানা সম্ভব নয়। শুরুতে গুগলও আইনটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। অস্ট্রেলিয়ায় সেবা বন্ধের হুমকি দিলেও পরে দেশটির প্রকাশকদের সঙ্গে কনটেন্ট শেয়ারিং চুক্তি করে তারা। যদিও এ চুক্তির আর্থিক লেনদেন বিষয়ক কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
এদিকে, সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে ফেসবুক জানিয়েছে, মূলত ফেসবুক এবং সংবাদ প্রকাশকদের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি করছে ‘অস্ট্রেলিয়ায় প্রস্তাবিত আইনটি। তাই ফেসবুক এই পথ বেছে নিয়েছে।
বেরিয়ে পড়ছে থলের বিড়াল
প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা অস্ট্রেলিয়ার এই পদক্ষেপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর নির্ভরশীলতা এবং ডিজিটাল কন্টেন্টের বাজারে নতুন মোড় হিসেবে দেখছেন। ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাণিজ্য থেকেই বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের আয়ের সিংহভাগ আসে। আর এ আয়ের উৎস স্থানীয় নিউজ, ইউজারদের ডিজিটাল কনটেন্ট, যেখান থেকে উপার্জিত আয়ের খুব সামান্যই প্রকাশকদের সাথে ভাগাভাগি করে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
গত বছর অস্ট্রেলিয়ান প্রকাশকরা ফেসবুকে লিংক শেয়ারের মাধ্যমে আয় করেছিলেন প্রায় ৪০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। কিন্তু এর তুলনায় ফেসবুকের আয় ছিল অনেক অনেক বেশি। জানা যায়, ১০০ ডলারে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে অস্ট্রেলিয়ায় ৮১ ডলারই পায় ফেসবুক ও ইউটিউব।
গত বছর অস্ট্রেলিয়ান প্রকাশকরা ফেসবুকে লিংক শেয়ারের মাধ্যমে আয় করেছিলেন প্রায় ৪০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। কিন্তু এর তুলনায় ফেসবুকের আয় ছিল অনেক অনেক বেশি। জানা যায়, ১০০ ডলারে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে অস্ট্রেলিয়ায় ৮১ ডলারই পায় ফেসবুক ও ইউটিউব।
এছাড়া, ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২.২৬ বিলিয়ন, যাদের অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের, কোম্পানির দে’য়া তথ্য অনুসারে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো এবং ফিলিপাইন অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারীর আবাসস্থল।
বৈশ্বিক সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটে ফেসবুকের শেয়ার বিস্ময়কর। যদিও কোম্পানিটা যৌথ। যুক্তরাষ্ট্রকে ভিত্তি করে বিশ্বের প্রথম ১১টি সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি নিয়ে এটি গঠিত। এর মধ্যে ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, টাম্বলার আছে। যে কারণে তথ্যপ্রযুক্তির এই ভৌগোলিক কেন্দ্রিয়করণ কয়েক বিলিয়ন নন-আমেরিকান ইউজার এবং তাদের সরকারকে কতিপয়ের কাছে করে তুলেছে প্রকাশ্য গোপন।
কানাডার সমর্থন
অস্ট্রেলিয়া সরকার এই ব্যবস্থাকেই হয়তো ভাঙতে চেয়েছেন। স্থানীয় খবরে ফেসবুকের ফ্রি-একসেস বন্ধ করার আইন তাই সামনে উঠে এসেছে। এদিকে, কানাডা সরকার পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার এই উদ্যোগকে। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ায় নিজেদের প্লাটফর্মে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর কনটেন্ট শেয়ারিং বন্ধ করায়, ফেসবুকের নিন্দা জানিয়ে কানাডাও ভবিষ্যতে এমন আইনের দিকে নিজেদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বৃহস্পতিবার কানাডার ঐতিহ্যমন্ত্রী স্টিভেন গিলবো বলেছেন, তাঁর দেশ আসন্ন মাসগুলোতে অস্ট্রেলিয়ার পথ অনুসরণ করবে।
বৃহস্পতিবার কানাডার ঐতিহ্যমন্ত্রী স্টিভেন গিলবো বলেছেন, তাঁর দেশ আসন্ন মাসগুলোতে অস্ট্রেলিয়ার পথ অনুসরণ করবে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান চার্টবিট জানিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় ফেসবুক স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর কনটেন্ট শেয়ারিং বন্ধ করে দিলে অস্ট্রেলিয়ান সংবাদ পোর্টালগুলোতে আগের চেয়ে ১৩ শতাংশ কম মানুষ প্রবেশ করেছে।
এই দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের অবস্থান
স্থানীয় সংবাদ শেয়ারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর উপার্জিত অর্থ থেকে প্রকাশকদের ভাগ দেয়ার যে নীতি অস্ট্রেলিয়া গ্রহণ করতে বাধ্য করছে ফেসবুককে, এই নীতিতে উপকৃত হতে পারে বাংলাদেশও। এই নীতি গ্রহণ করলে আর্থিক সংকটে থাকা দেশের গণমাধ্যম শিল্প হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারবে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সংবাদমাধ্যমকে জানান, গণমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে আয়ের সুষম বণ্টন জরুরি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো আমরাও কোনোভাবেই ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবকে বাগে আনতে পারছি না। তবে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা খুব প্রয়োজন।
এছাড়া, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতেও, ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাণিজ্যে ফেসবুক, গুগলের একচেটিয়া দখলদারিত্ব। অস্ট্রেলিয়ার এই আইনকে তাই স্বাগত জানাতেই হয়। বাণিজ্যের পেশি ফুলিয়ে গণতন্ত্রেও প্রভাব রাখছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। জানুয়ারিতে ট্রাম্পের একাউন্ট সরিয়ে নেয়ার পর থেকেই এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল বেশ জোরেশোরেই। একটি সংস্থা তাহলে চাইলেই পৃথিবীর সবথেকে ক্ষমতাবান মানুষটিরও মুখ বন্ধ করে দিতে পারে। তাই এখনই উচিৎ বিশ্ব হস্তীদের অস্ট্রেলিয়ার সিদ্ধান্তের পাশে দাঁড়ানো। সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে আরোপিত উদারনীতির লাগাম টেনে ধরা।
এসডব্লিউ/১১২০
আপনার মতামত জানানঃ