নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির (২৫) মারা গেছেন। শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাত পৌনে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর খবরে কোম্পানীগঞ্জে বিবদমান ওই দুই পক্ষ তাকে নিজেদের লোক বলে মিছিল করেছে।
নিহত বোরহান উপজেলার চরফকিরা ইউনিয়নের নোয়াব আলী মাস্টারের ছেলে। তিনি নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে সম্প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করেন। মুজক্কির অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তা বাজারের নোয়াখালী জেলা প্রতিনিধি ছিলেন।
বোরহান উদ্দিনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) বাচ্চু মিয়া। তিনি জানান, হাসপাতালের আইসিইউতে রাত পৌনে ১১টার দিকে মারা যান বোরহান উদ্দিন। এর আগে, শুক্রবার রাতে বোরহান উদ্দিনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মোহাম্মদ আলাউদ্দীন জানান, বোরহান উদ্দিনের গলায় ছররা গুলি লেগেছিল।
কোম্পানিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসান ইমাম রাসেল জানান, শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে উপজেলার চরফকিরা ইউনিয়নের চাপরাশিরহাট তরকারি বাজারের সামনে সংঘর্ষের এ ঘটনা ঘটে। ওই সময় সাংবাদিক বোরহান সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহের সময় গুলিবিদ্ধ হন। এ অবস্থায় প্রথমে তাকে উদ্ধার করে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিলে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই কাদের মির্জা গত মাসে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপের পৌরসভা নির্বাচন সামনে রেখে আলোচনায় আসেন। কোম্পানিগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভায় মেয়র পদে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য দেন তিনি। ভোটে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় দফায় মেয়র হওয়ার পরেও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা করে আসছিলেন তিনি। এরমধ্যে কোম্পানীগঞ্জে হরতালও পালন করেছেন আবদুল কাদের মির্জা।
ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে তার ‘মিথ্যাচার ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের’ প্রতিবাদে শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বিকালে উপজেলার চাপরাশিরহাট পূর্ব বাজারে মিছিল বের করেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে চাপরাশিরহাট পূর্ব বাজার এলাকায় দলীয় নেতা–কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগের উপজেলা সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল। এ সময় সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি মিছিল বাজারের দলীয় কার্যালয়ে দিকে যায়। হঠাৎ করে ওই মিছিলে আবদুল কাদের মির্জার সমর্থক জামাল উদ্দিন লিটনসহ কিছু লোক বাধা দেয়। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিপেটা ও ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। এ সময় দুই পক্ষের সংঘর্ষের ভিডিও চিত্র ধারণকালে সাংবাদিক বোরহান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। এ সংঘর্ষের সময় মোজাক্কিরসহ সাতজন গুলিবিদ্ধ হন, আহত হন আরও অন্তত ২৫ জন।
সংঘর্ষের পর ফেইসবুক লাইভে এসে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা অভিযোগ করেছিলেন, চাপরাশিরহাটে তার লোকজনের ওপর সাংসদ একরাম চৌধুরী ও সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারীর লোকজন পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছেন। হামলায় তার পক্ষের অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।
অন্যদিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল বলেছিলেন, বিকেলে আমার বাড়িতে ওবায়দুল কাদেরসহ দলীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে আগামীকালের সংবাদ সম্মেলন বিষয়ে প্রস্তুতিমূলক সভা চলাকালে বাড়ির বিভিন্ন দিক থেকে অনবরত গুলি আসতে থাকে। এ সময় সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হামলায় তার অন্তত ৫০ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
এদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান দাবি করেছেন, বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির সাংবাদিক হলেও তিনি তার অনুসারী ছিলেন। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্তপূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির হত্যার দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে৷ স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের বেওপরোয়া হয়ে ওঠার কারণেই সাংবাদিক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। দলীয় প্রভাব খাটিয়েই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সরকার দলীয় বিধায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে কেউ সাহস করে না। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনও কোনো ভূমিকা নিতে পারে না। এসবের শাস্তি নিরূপণ নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৫৯
আপনার মতামত জানানঃ