অতিরিক্ত মাত্রায় দূষণ ও দখলদারদের কবলে মৃতপ্রায় হয়ে উঠেছে রাজধানীর খালগুলো। যে খালে একসময় সাম্পান-নৌকা চলতো অনায়াসে, সে খাল এখন পলিথিন ও প্লাস্টিকের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। খালের কোনো কোনো অংশ আবার চলে গেছে ভবনের তলায় কিংবা ঝুঁপড়ি দোকান-ঘরের আড়ালে দখলদারদের হাতে। ভরাট, দখল আর দূষণে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যতটুকু বেঁচে আছে তাও পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। সরকারের ব্যবস্থাপনার ভুলে খালগুলো ১০০ ফুট প্রস্থ থেকে এখন ১০ থেকে ২০ ফুটের সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে। ১০ ফুটের খাল দেখে বুঝার উপায় নেই যে এগুলো খাল। মনে হবে ময়লার ভাগাড়। উত্তরা, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডির খাল বাদে বেশিরভাগের চিত্র একই।
সরেজমিন দেখা যায়, কোথাও জমে আছে পলিথিন ও প্লাস্টিক মোড়কে মেশানো আবর্জনার বিশাল স্তূপ। গৃহস্থালির যত রকমের আবর্জনা আছে সবই এসে পড়ছে এই খালে। আবর্জনার চাপে কিছু কিছু জায়গায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। টোকাই শিশুদের কেউ কেউ এপাড় থেকে ওপাড়ে হেঁটে ওই আবর্জনার স্তূপ থেকে খুঁজে নিচ্ছে প্লাস্টিকের খালি বোতল, কৌটা এসব। যদিও এসব থাকার কথা সিটি করপোরেশনের ময়লার ভাগাড়ে। যেখানে খালের পাশে হাঁটলে শোনা যাওয়ার কথা পানি প্রবাহের কল কল শব্দ। সেখানে কান পাতলে শোনা যায় খালগুলোর নীরব কান্না। খাল-ড্রেন আবর্জনায় ভরাট হওয়ার কারণে প্রতি বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয় রাজধানীতে। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে খাল খনন করা হলেও তার সুফল থাকছে অধরা।
৩২ বছর খালের দায়িত্ব ওয়াসার হাতে থাকলেও হয়নি কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন। হয়েছে দখল, ৬০ ফুট থেকে ১০ ফুটে নেমে এসেছে খালের প্রস্থ। অবৈধ দখলদার ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে যার মতো করে খাল দখল করে স্থাপনা তৈরি করেছে। নানান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ২০২১ সালের প্রথম দিন ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন খালের দায়িত্ব পেয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। দায়িত্ব পেয়েই খাল পরিষ্কারে নামে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এতে নগরবাসী আশার নতুন এক আলো দেখতে পাচ্ছে। তবে মাঠে নেমে খালের করুণদশা দেখে অসহায়ত্বের কথা বলছেন মন্ত্রী ও মেয়ররা।
এ বিষয়ে নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু খালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে দিলে হবে না। সেই সাথে জনবল, অর্থ ও ক্ষমতা দিতে হবে সরকারকে। সিটির অনেক খাল এখনো জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেগুলোও সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
এদিকে ঢাকার বুকে অবশিষ্ট থাকা ৩৯টির মধ্যে আওতাভুক্ত ২৬টি খাল উদ্ধারে দুই সিটি সক্রিয় হলেও এসব খালের পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা নেই। পরিষ্কার করে খালগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানোর চেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্জ্য-আবর্জনা। বর্ষাকালে পানি চলাচলে বাধা পেয়ে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর মানুষরা ভোগান্তি পোহালেও তাদেরই ফেলা ময়লা-আবর্জনার আঘাত থামছে না খালগুলোর বুকে।
এ অবস্থায় সিটি কর্তৃপক্ষের সক্রিয়তার পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতনতা না থাকলে খাল উদ্ধার কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে বলেই নগর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। খাল উদ্ধারে দুই সিটির উদ্যোগ আলোর মুখ দেখবে না বলেও তাদের আশঙ্কা। ঢাকায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে বেদখলের কারণে খালগুলোতে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ অনেকদিনের। আর খাল দখলে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অভিযোগও উঠে বিভিন্ন সময়ে। মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও কয়েকদিন পর আবার দখলদাররা ফিরে আসে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকার কাঁটাসুর, ইব্রাহিমপুর, কল্যাণপুর, আবদুল্লাহপুর, দিয়াবাড়ি, বাউনিয়া, কসাইবাড়ি, সুতিভোলা, ডুমনি, বোয়ালিয়া, শাহজাদপুর, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ, বাইশটেকি, জিরানী, মান্ডা, শ্যামপুর, শাহজাহানপুর, গোবিন্দপুর খাল রয়েছে। খালগুলো ঘুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, খালগুলো বেশিরভাগের দুই পাড় দখল হয়ে গেছে। ৬০ থেকে ১০০ ফুটের খাল ১০ থেকে ২০ ফুট সরু হয়ে গেছে। বর্জ্য-আবর্জনায় ভরাট হয়ে পড়ায় পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ স্থানে খালের ভেতর পানি আছে কি না তা আবর্জনার কারণে দেখা যায় না। শীত মৌসুমে নাগরিকদের ভোগান্তি না থাকলেও পানি চলাচল বাধা পেয়ে বর্ষার বৃষ্টি কিছুটা দীর্ঘ হলেই খালের পানি চলে আসে সড়কে।
বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব প্লানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদের করা একাধিক জরিপে রাজধানীর খালের সংখ্যা দেখেছেন বিভিন্ন রকম। তিনি বলেন, আমি আমার একাধিক জরিপে রাজধানীতে খালের সংখ্যা একেক রকম পেয়েছি। কখনও ৫২টি, কখনও ৪৬টি আবার কখনও ৪২টি। দীর্ঘ ৩২ বছর পর ওয়াসার কাছ থেকে খালের দায়িত্ব ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দেয়া হয়েছে। তবে শুধু দায়িত্ব দিলেই হবে বলে আমি মনে করি না। এর সঙ্গে অর্থ, জনবল ও কারিগরি সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করা।
এদিকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, আমাদের সিস্টেম এভাবে তৈরি করা হয়েছে যেখানে জবাবদিহিতা কম। তিনি বলেন, আমাদের খাল অনেকগুলো দখল হয়ে গেছে। খালগুলো অবৈধ দখলদাররা দখল করেছে এবং সরকারও দখল করেছে। সরকার আইন করে খাল দখল করেছে। তাই সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব না। কিন্তু যেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব, আমরা সেগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। আমি বিশ্বাস করি এটা সম্ভব।
চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে মোহাম্মদপুর এলাকার রামচন্দ্রপুর খালের কয়েকটি অংশের বর্জ্য উত্তোলন শুরু করে ডিএনসিসি। প্রথমে যন্ত্র ব্যবহার ও পরে খালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নামিয়ে দুই স্তরে বর্জ্য উত্তোলন করা হয়। খাল থেকে উঠে আসে গৃহস্থালির বর্জ্য, ফেলে দেয়া আসভাবপত্র, বালিশ, কাঁথা, পলিথিন, কর্কসিট, ভাঙারির দোকান থেকে ফেলে দেয়া বিপুল পরিমাণ বর্জ্য। পরিষ্কারের কিছুদিন পরই আবারও খালে ময়লা জমতে শুরু করেছে। খালের বিভিন্ন স্থানে এরইমধ্যে ময়লা জমে ভাগাড় হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, খালের পাড়ের বসতবাড়ি থেকে খালে ময়লা ফেলা হচ্ছে। পাশাপাশি খাল পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা দোকানগুলোর পলিথিন, বিভিন্ন দোকানের বর্জ্য আবর্জনা ফেলা হয় খালে। এসব ঘটনা প্রতিদিনের।
খালে বর্জ্য জমার কারণ জানতে চাইলে রামচন্দ্রপুর খাল সংলগ্ন মোহাম্মদীয়া হাউজিং এলাকার বাসিন্দা লিটন হোসেন বলেন, ‘এই খালে ময়লা জমার ঘটনা নতুন নয়। খালের আশেপাশে যারা থাকে, তারাই জানালা দিয়ে, বারান্দা দিয়ে খালে ময়লা ছুড়ে মারে।’
স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের ভাষ্য, খালে ময়লা ফেললে কোনো বাঁধার মুখে পড়তে হয় না। এমনকি কোনো সতর্কবার্তাও লেখা নেই খালের পাড়ে। ফলে স্থানীয়রা বেশ আয়েশের সঙ্গেই খালকে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করে চলেছেন। তাদের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেছে মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড, সোসাইটি ও নবোদয় হাউজিং এলাকায়।
ঢাকার সকল খাল নিয়ে কাজ করেছে নদী ও খাল বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসি। সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ এজাজ গণমাধ্যমকে জানান, খাতা কলমে এসব খালের যে আকার আয়তন আছে বাস্তবে তেমনটি নেই। খাল পাড়ের বাসিন্দারা দিনের পর দিন খালে ময়লা ফেলে চলেছেন। সচেতনতার অভাবে খাল ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘খালের পাড়গুলো এমনভাবে রয়েছে যে, স্থানীয়রা খুব সহজেই খালে ময়লা ফেলার সুযোগ পাচ্ছে। খালের পাড়ে উঁচু প্রাচীর তৈরি করতে হবে। যেন মানুষ খালে ময়লা ফেলতে না পারে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। কার্যকরি উদ্যোগ না নিলে খালে ময়লা ফেলা বন্ধ হবে না।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, ‘এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। জনগন সচেতন না হলে শুধু চোর-পুলিশ করে পাহারা দিয়ে কতক্ষণ রাখা যাবে? খালের মধ্যে তারা জাজিম ফেলে দেয়, তোষক ফেলে দেয়, পুরনো খাট, ট্রাংক ফেলে দিচ্ছে। এগুলো তো দুর্ভাগ্যজনক। জনগনকে সচেতন করতে সিটি করপোরেশন কাজ করছে জানিয়ে উত্তর সিটির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রয়োজনে সমস্যা সমাধানে আইনের প্রয়োগ করা হবে। ভ্রাম্যমান আদালত চালিয়ে আইনের প্রয়োগ করার জন্য আমরা বলেছি। পাশাপাশি মাইকিং করে, স্থানীয়ভাবে সচেতনতা কার্যক্রমের চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে শিগগির একটা গণবিজ্ঞপ্তি জারি করব।’
এসডব্লিউ/এমএন/এফএ/১৪৩৪
আপনার মতামত জানানঃ