মানবসৃষ্ট নানা কারণে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ধ্বংস হচ্ছে বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য। বাংলাদেশ এক সময় জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ থাকলেও বর্তমানে তা প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এরইমধ্যে ধ্বংস হয়েছে বিপুল বনভূমি, বিলুপ্ত হয়েছে অসংখ্য পশু-পাখি, বন্যপ্রাণী। মানবসৃষ্ট কারণেই দেশে অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রাম করে যাচ্ছে আরেকটি বন্যপ্রাণী শকুন। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউসিএন) তথ্যানুযায়ী, শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতে দ্রুততম বিলুপ্ত হতে চলা প্রাণী প্রজাতি হচ্ছে শকুন। বর্তমানে দেশে শকুনের সংখ্যা কমবেশি ২৬০টির কাছাকাছি। দেশে শকুনের সংখ্যা এভাবে কমে যাওয়ার পেছনে দায়ী করা হচ্ছে পশুপালন খাতে কিটোপ্রোফেন ও ডাইক্লোফেনাক সোডিয়ামের মতো অনিরাপদ ওষুধের ব্যবহারকে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পশুপালন খাতে কিটোপ্রোফেন-জাতীয় ওষুধের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়া হয়। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রীরা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বৈঠকে যোগ দেন।
সভা শেষে সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, গবাদিপশুর ব্যথানাশক কিটোপ্রোফেন-জাতীয় ওষুধের প্রভাবে শকুনের সংখ্যা নেমেছে ২৬০টিতে। দেশে মহাবিপন্ন এ শকুন রক্ষায় কিটোপ্রোফেন-জাতীয় ওষুধের উৎপাদন বন্ধে সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
স্বাধীনতার সময়েও দেশে শকুনের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের বেশি। ওই সময় শকুনের ব্যাপক উপস্থিতি থেকে বেশকিছু গণকবরও শনাক্ত হয়েছিল। এরপর গত কয়েক দশকে বাংলার আকাশ থেকে শকুনের সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। বিষয়টি সামনে আসার পর শকুনের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে উদ্যোগী হয় সরকার। তবে শকুন সংরক্ষণে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পরও পাখিটির সংখ্যা কমে যাওয়া ঠেকানো যায়নি। এর কারণ অনুসন্ধান করে বিশেষজ্ঞরা দেখতে পেয়েছেন, পশুপালনে কিটোপ্রোফেন ও ডাইক্লোফেনাক সোডিয়ামের মতো ওষুধের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে শকুনের সংখ্যা কমছে। এরই মধ্যে পশুপালনে ডাইক্লোফেনাক সোডিয়ামের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কিটোপ্রোফেন বন্ধেও সিদ্ধান্ত হয়েছে গতকালই ।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেনারি মেডিসিনের অধ্যাপক লিন্ডসে ওক তার এক গবেষণায় দেখতে পান, শকুন বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার। এই ওষধু ব্যবহারের পর পশুটির মৃত্যু হলেও মৃত পশুর দেহে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়ে যায়। শকুন ওই মৃত খাওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ওষুধের প্রভাবে মারা যায়।
লিন্ডসের গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র শূন্য দশমিক ২২ মিলিগ্রাম ডাইক্লোফেনাক একটি শকুনের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ঠ। ১৯৮০ দশকে ওষুধটি ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সস্তায় পাওয়া যায় বলে গবাদিপশুর প্রায় সব রোগেই এই ওষুধটি কৃষকেরা ব্যবহার করতে থাকেন, ফলে দলে দলে মারা যেতে থাকে শকুন। কিন্তু ভারতীয় ভেটেনারি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে, গবাদিপশুর যেসব রোগ হয় তার শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে।
এ ছাড়া আইইউসিএনের সহযোগী সংগঠন বার্ডসলিস্ট অর্গানাইজেশনের মতে, অতিরিক্ত কীটনাশক ও সারের কারণে পানি দূষণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া, বিমানের সাথে সংঘর্ষ,কবিরাজি ওষুধ তৈরিতে শকুনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার ইত্যাদি কারণে প্রতিবছর শকুনের ব্যাপক প্রাণহানি হয়। এ ছাড়া খাদ্য সংকট, নিম্ন জন্মহার, বিভিন্ন কারণে বট, পাকুড়, শেওড়া, শিমুল, ছাতিম, দেবদারু, অশ্বত্থ, কড়ই, তেঁতুল, অর্জুন, পিপুল, নিম, তেলসুর ইত্যাদি বড় গাছ ধ্বংসের কারণে বাসস্থানের প্রচণ্ড সংকটও শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।
পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, শকুনের ওপর এমন দুর্যোগ চলমান থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যেই দেশ থেকে হারিয়ে যাবে শকুন।
এ পর্যন্ত শকুন সংরক্ষণে সরকারিভাবে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের আওতায় শকুন রক্ষায় খুলনা ও সিলেটের ৪৭ হাজার হেক্টর এলাকাকে বন্যপ্রাণীর জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা ছাড়াও শকুনের প্রজননকালে ক্ষতিকর রাসায়নিক যেমন—ডাইক্লোফেনাকমুক্ত খাবার সরবরাহ, পাখিটির আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহূত গাছ চিহ্নিত করে তার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং অসুস্থ শকুন উদ্ধার ও সুস্থ করে সাফারি পার্কে ছেড়ে দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক জাহিদুল গণমাধ্যমকে বলেন, শকুন রক্ষায় সরকারের আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। উঁচু বৃক্ষে শকুন বাসা বাঁধে। তাই এসব বৃক্ষ রক্ষা করতে হবে। সুন্দরবন ও সিলেট ছাড়াও দেশের অন্যান্য এলাকায় শকুনের বসতি থাকতে পারে। কেউ যদি তা দেখতে পায়, তাহলে বন বিভাগকে জানানোর অনুরোধ করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্বে ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। এর মধ্যে পশ্চিম গোলার্ধে রয়েছে সাত প্রজাতির। পূর্ব গোলার্ধে (ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া) ঈগলের সঙ্গে সম্পর্কিত ১১ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। তবে বাংলাদেশে রয়েছে ছয় প্রজাতির শকুন। এর মধ্যে চার প্রজাতি স্থায়ী এবং দুই প্রজাতি পরিযায়ী। স্থায়ী প্রজাতির মধ্যে রাজশকুন অতি বিপন্ন। একসময় শকুনের ছায়াও মানুষের কাছে অপ্রিয় ছিল, আজ সেই পাখিটির জন্য করুণা হচ্ছে। কারণ, এই প্রাণিটি এখন বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির। এখনই বিলুপ্তপ্রায় প্রাণিটি রক্ষায় ক্যাপটিভ ব্রিডিংয়ের উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। শকুন প্রজাতিকে এ প্রক্রিয়ায় খাঁচায় রেখে বংশবৃদ্ধি করে উপযুক্ত সময়ে ছেড়ে দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ