সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : তুষারপাত ও শৈত্য প্রবাহ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে প্রতি বছর শীতের শুরুতে টাংগুয়ার হাওরে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌলভীহাঁস, বালিহাঁস, লেঞ্জা, চোখাচোখি, বেগুনি কালেম প্রভৃতি অতিথির পাখির আগমন ঘটত। কিন্তু গত কয়েক বছরের মত এবারও শুনসান নিরবতা বিরাজ করছে মাদার ফিসারিজ রামসার সাইট টাংগুয়ার হাওরের চারপাশ। এরপরও অর্থের লোভে বিভিন্ন ধরনের কারেন্ট জাল ও ফাদঁ দিয়ে শিকারীরা শিকার করছে প্রতিদিন অতিথি পাখি। অতিথি পাখি সংরক্ষণে আইন থাকলেও এসব পাখি শিকারীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাহিরে। এদের রয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। শুধু তাই নয়, সীমান্ত এলাকায় সাংবাদিক নামধারী কিছূ লোক এই সব অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ না করে উল্টো তারা নিজেরা সংবাদ প্রকাশের ভয় দেখিয়ে মাসোয়ারা বা কমিশন নিয়ে অতিথি পাখি শিকারের সংবাদ আড়াল করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে দিনদিন পাখির আগমন কমে যাচ্ছে। প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় অতিথি পাখির সংখ্যা কম দেখা যাচ্ছে।
এদিকে করোনা মহামারীর মধ্যে প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি ভালবাসার কারণে প্রতিদিনেই দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক টাংগুয়ার হাওরে অতিথি পাখি দেখতে এসে পাখির দেখা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফেরত যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দীর্ঘদিনের দাবী ছিল টাংগুয়ার হাওরকে কেন্দ্র করে একটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের। এছাড়া পরিবেশবিদদের দাবি ছিল টাংগুয়ার হাওরকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মাছ ও অতিথি পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করার। আগত পর্যটকগন প্রাণ ও প্রকৃতি সংরক্ষণে সরকার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
জানা যায়, টাংগুয়ার হাওর ১০০কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ভারতের মেঘালয় পাহড়ের পাদদেশে অবস্থিত। তুষারপাত ও শৈত্য প্রবাহ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে প্রতি বছর শীত মৌসুমে শীত প্রধান দেশ সূদুর সাইবেরিয়া, চীন,মঙ্গোলিয়া, ইউরোপ, নেপালসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসত এই হাওরে। দীর্ঘ পরিভ্রমন শেষে পাখিরা প্রথমে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও প্রচুর খাবার সমৃদ্ধ হাওরে বিচরন করে তারা আবার সজীবতা ফিরে পেত। পাখিদের মাছ শিকার, শামুক খাওয়া, জলকেলি, খুনটুশি আর কিচিরমিচির কলতানে যেন র্স্বগীয় পরিবেশে হাওরপাড়ের মানুষের ভোরের সূর্য উঠার পূর্বেই ঘুম ভেঙ্গে যেত। টাংগুয়ার হাওরের পাড় পাখিপ্রেমী পর্যটকদের জন্য ছিল এক স্বর্গভূমি। কিন্তু এবার পর্যাপ্ত অতিথি পাখি না থাকায় সবাই হতাশ।
হাওর পাড়ের স্থানীয় সচেতন বাসিন্ধাদের অভিযোগ ও অনুসন্ধানে জানা যায়, হাওরে রাতের আধারে এক শ্রেনীর অসাধু পাখি শিকারী, পাখি ব্যবসায়ীদের অবাধ বিচরণের কারনে হাওরের নানান প্রজাতির জলাবন, হিজল কড়চ, নলখাগড়া বিলুপ্তির পথে। হাওরে পাখি শিকারীদের অবাধ পাখি শিকার ও ইঞ্জিন চালিত নৌকার শব্দের কারণে অতিথি পাখিরা হাওরকে নিরাপদ মনে করছে না। এছাড়া হাসেঁর খামারীরা হাঁসের পাল নিয়ে হাওরে ছেড়ে দেওয়ার কারণে পাখির খাবার হাঁস খেয়ে ফেলছে, যার কারণে উড়ে আসা অতিথি পাখিদের খাবারে সংকট দেখা দিয়েছে। মনুষ্য সৃষ্টি এসব সমস্যার কারণে অতিথি পাখিদের আগমন কমে গেছে টাংগুয়ার হাওরে।
পৃথিবীতে প্রায় ১০হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১হাজার ৮শত ৫৫প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী। টাংগুয়ার হাওরে প্রায় ২১৯প্রজাতির পাখির অবস্থান ছিল। এর মধ্যে ৯৮প্রজাতির পরাযায়ী, ১২১প্রজাতির দেশি ও ২২প্রজাতির হাঁসজাত পাখির বিচরন ছিল।
২০১১ সালে টাংগুয়ার হাওরে পাখি শুমারীতে এই হাওরের বিভিন্ন বিলে প্রায় ৬৪হাজার পাখির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এতে ৮৬জাতের দেশি ও ৮৩জাতের বিদেশি পাখি ছিল।
তাহিরপুর উপজেলার সদরের বাসিন্দা সাদেক আলী জানান, আগে শীতমৌসুমে বাড়িতে রাতে ঘুমানোর আগে আকাশে পাখিদের উড়ার শো শো শব্দ আর ডাক শুনা গেলেও এখন আর শোনা যায় না। কারন প্রতিবছরই পাখির আগমন কমে এসেছে। শীতের শুরুতে পাখি না আসায় আর আশা করা যায় না যে পাখি আসবে। এদিকে ভালো যোগাযোগ, আবাসিক ও খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকার কারনে পর্যটকদের টাংগুয়ার হাওরে বেড়াতে আসাও কমে যাচ্ছে।
টাংগুয়ার হাওরে বেড়াতে আসা আমিনুর রহমান জানান,এবারও হাওরে পাখি নেই বললেই চলে। বিদেশি পাখির দেখা পাই নি। টাংগুয়ার হাওরে প্রাণী সংরক্ষন ও নিরাপত্তা আইন কার্যকর, জীববৈচিত্র রক্ষা ও পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যুগপোযোগী কার্যকর প্রদক্ষেপ গ্রহন করা না হলে পর্যটকরা ভবিষ্যতে এমুখো আর হবে না।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল জানান, হাওরে কোথায় কোথায় পাখি শিকার করা হচ্ছে, কিভাবে কোথায় এসব পাখি বিক্রি হচ্ছে এবং কিভাবে পাখি পাচার হচ্ছে সব তথ্য স্থানীয়রা আমাদেরকে জানালে অবৈধ ভাবে পাখি ও মৎস্য শিকারকারী ও এর সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার মতামত জানানঃ